মরণ রে . . .ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৩১ জুলাই ২০০৫ রবিবারের সাময়িকী; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
মৃত্যু শাশ্বত ও চিরন্তন। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই একদিন সকল চলে যেতে হবে জীবন নদীর ওপারে। তবুও মৃত্যুকে ঘিরে আমাদের মনে এত ভয়-শঙ্কা কেন? কেন আমরা সহজভাবে মেনে নিতে পারি না জীবনের এই নিশ্চিত পরিণতিকে? মৃতুঞ্জয়ী সাধনার বীজমন্ত্র শোনালেন- ডাঃ পার্থপ্রতিম।
মৃত সেনানীকে নিয়ে এল তারা ঘরে/ কাঁদল না প্রিয়া মুর্চ্ছিতা হল না তো/ সেবিকা সকলে দেখিয়া বলিল ‘ওরে/ না কাঁদিলে তার মরণ নিশ্চিত।’
লর্ড টেনিসনের লেখা Home they Brought her Warrior Dead কবিতার প্রথম পংক্তির বঙ্গানুবাদ। এক সেনার মৃত্যুকে ঘিরে কবি তার রণক্ষেত্রে সৈনিকের বীরগতি লাভ, তেমন চমকপ্রদ ঘটনা নয়। আসলে কোনো মৃত্যুতেই কোনো চমক নেই। মরণ জীবনের এক স্বাভাবিক পরিণতি। তবুও সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মৃত্যু মানুষের মনে ভয়, বেদনা, দুঃখ, হতাশা বয়ে নিয়ে এসেছে। এ কী মৃত্যু সমন্ধে আমাদের অজ্ঞতা? ভ্রান্তি? না কী প্রচলিত অভ্যাস। উত্তর খুঁজতে গিয়ে আসুন, মরণের বিপরীতে ছুটে চলা জীবনের স্বরূপটি বিজ্ঞানের নিরিখে দেখে নেওয়া যাক।
আমরা জানি কোনো এক আদিম প্রভাতে সমুদ্রের বুকে অতিবেগুনি রশ্মি ও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে সরল জৈব অণু থেকে সৃষ্টি হয় জটিল প্রোটিনের। যে প্রোটিন নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম। জীবনের ধারক ও বাহক ডি.এন এ-র এটাই ছিল আদিম রূপ। জীবনের সরল সুরুয়াৎ সমন্ধে এরকমই একটি ধারণা বিজ্ঞানীরা দিয়ে থাকেন। সেই সরল জীব অভিব্যক্তির ও বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে আজকের মানবরূপে ধরার বুকে ধরা দিয়েছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে প্রায় দুশো কোটি বছর আগে এই বসুন্ধরায় প্রথম প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছিল।
জীবন হল বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। আমরা যখন জীবিত তখন এইসব ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় বজায় থাকে। মরণে আমাদের শরীরের রাসায়নিক সাম্য চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। জীব ও জড়ের মধ্যে যা পার্থক্য, জীবন ও মরণের তফাৎটা সেরকমই। সজীব দেহ ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জীবিত কোষের সমষ্টি। আধুনিক ফেজ কনটাট মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে দেখলে দেখতে পাব - কোষের মধ্যকার প্রোটোপ্লাজম ও ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কোষাণু সবই সঞ্চারণশীল। কিন্তু কোষটি যখন মৃত তখন সব সঞ্চারই স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন তার মধ্যে ব্রাউনীয় মোশন বা সচলতাই শুধু বজায় থাকে। তরল বা বাতাসে ভাসমান আণুবীক্ষণিক কণিকা সবসময়েই ইতস্তত ঘোরাফেরা করে। বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন সবার প্রথমে বিষয়টি লক্ষ্য করেন। এটি জড় কণিকার একটি ধর্ম। সহজ বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় মৃত্যুতে আমাদের দেহের মধ্যকার অক্সিজেন চক্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। আমরা নিয়ত বাতাস থেকে ফুসফুসের মাধ্যমে অক্সিজেন সংগ্রহ করি। সেই অক্সিজেন হৃদযন্ত্র ও রক্তের মাধ্যমে কোষে কোষে পৌঁছে যায়। আমাদের শরীরে মোট যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন তার চারভাগের একভাগ লাগে মস্তিস্কে।
প্রতি মুহূর্তে আমাদের দেহের অসংখ্য কোষের মৃত্যু হচ্ছে। অথচ মৃত্যুর লক্ষণ সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে না। সেই সংকেত দেখা দিলে আর পুনরায় তাকে বাঁচানো এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে হৃদযন্ত্রের লাব-ডুব থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না কারও মস্তিস্কের সকল কোষের মৃত্যু হচ্ছে ততক্ষণ তাকে মৃত বলা যাবে না। এর পোষাকী নাম ব্রেন ডেথ। এমনও দেখা গেছে হৃদযন্ত্র বহুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর আবার সচল হয়ে উঠেছে। বেঁচে উঠেছে তথাকথিত মরা মানুষ। না, শুধু রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীর কথা বলছি না, হাল আমলের এমন অনেক ঘটনা ঘটে।
আসুন, আমাদের প্রবুদ্ধ পিতামহরা মৃত্যুকে কী চোখে দেখছেন তা জেনে নেওয়া যাক। পুরাণে মৃত্যুকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা অনেক অংশে বিজ্ঞানসম্মত। আমাদের এই মাটির পৃথিবীতে জীবকূল বেঁচে থাকার একটি সীমা রয়েছে। জনসংখ্যা মাত্রাধিক হয়ে গেলে তো সবার পক্ষেই বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের জন্যই মৃত্যুর সৃষ্টি। পুরাণ বলছে, দেবলোকে পিতামহ ব্রহ্মা নির্মাণের আনন্দে বিভিন্ন প্রকার জীব সৃষ্টি করার পর প্রজারূপ মনুষ্য সৃষ্টি করলেন। এই অসংখ্য জীবে ত্রিভুবন একেবারে পূর্ণ হল। তারপর মনুষ্য জাতি হয়ে পড়ল উচ্ছৃঙ্খল পাপাচারি। সৃষ্টির এই অবস্থা দেখে স্বাভাবিকভাবেই স্রষ্টা ব্রহ্মা রেগে আগুন। হ্যাঁ প্রকৃত অর্থেই আগুন। তাঁর দেহ থেকে নির্গত হতে থাকল তেজ, সেই তেজে দশদিক দগ্ধ হতে লাগল। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে দেবাদিদেব মহাদেব বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ব্রহ্মাকে কাতর অনুরোধ জানালেন শান্তভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে। ব্রহ্মা আপন তেজ প্রতিসংহার করলেন। সেই সময় তাঁর ইন্দ্রিয় থেকে নির্গত রশ্মিতে পিঙ্গলবসনা, কৃষ্ণনয়না, দিব্যকুন্ডল, ধারিনী, দিব্যাভরণভূষিতা এক নারীর আবির্ভাব হল। ব্রহ্মা এর নাম দিলেন ‘মৃত্যু’।
ব্রহ্মা মৃত্যুকে আদেশ দিলেন, ‘তুমি ধনী-নির্ধন, পন্ডিত-মুর্খ, নির্বিশেষ সকলকে সংহার করো’। এই নির্দেশ শুনে ‘মৃত্যু’ কাঁদতে লাগলেন। কারণ যারা প্রিয়জন হারাবে তারা তো ‘মৃত্যু’কেই শাপ-শাপান্ত করবে। ‘মৃত্যু’র দু-চোখ বেয়ে আসতে লাগল অশ্রুধারা। দুই করতলে তিনি ধারন করলেন অশ্রুরাশি। কাতর আবেদন ও অনুরোধ জানালেন ব্রহ্মাকে তাঁর এই নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়ার। প্রজাসমূহের আচার আচরণে সৃষ্টিকর্তা এতটাই বিরক্ত যে মৃত্যুদেবীর শত অনুরোধেও তিনি টললেন না। অবশেষে ‘মৃত্যু’ কয়েক লক্ষ কোটি বছর ধরে কঠোর তপস্যা করলেন। কখনও বাতাস খেয়ে, কখনও পায়ের একটি আঙ্গুলের ওপর দাঁড়িয়ে কাটাতে লাগলেন বছরের পর বছর। শেষমেষ ব্রহ্মার মন ভিজল। রাগ কিছুটা নরম হল। ব্রহ্মা বললেন, ‘প্রজাগন ব্যাধিপীড়িত হয়েই দেহত্যাগ করবে, তারা কখনোই তোমাকে দোষারোপ করবেনা। তোমার করতলে সঞ্চিত অশ্রুকণা ছড়িয়ে দাও। এগুলিই কাম, ক্রোধ, জরা, ব্যাধিরূপে মনুষ্য শরীরে প্রকট হবে। সেটাই হবে তাদের কষ্ট ও ধ্বংসের কারণ। তুমি মরণরূপে তাদের কষ্ট লাঘব করবে’।
পুরাণের এই কথাই অন্যভাবে বলেছেন আর্থার গিটারম্যান।
When life is woe,
And hope is dumb,
The world Says,’Go!’
The Grave says, ‘Come!
জীবন যখন দুঃখের সাগরে ডুবে যায়, সব আশা হয় বোবা, দুনিয়া তখন বিদায় জানায়। কবরের নিস্তব্ধতা জানায় স্বাগত।
জীববিজ্ঞানের চশমা দিয়ে দেখলে বুঝতে পারব মৃত্যু জীবনেরই দোসর। ভ্রুণ যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখনও তার মধ্যে বিরাজ করে মৃত্যুর সজীব ছায়া। গর্ভস্থ ভ্রুণের বহু দেহকোষ প্রতিদিন মারা যায়। তার জায়গায় সৃষ্টি হয় আরও বহুকোষ। শিশুদের ক্ষেত্রে দেহকোষের সৃষ্টিহার মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি। তাই তাদের দেহের বৃদ্ধি হতে থাকে। আবার যখন আমরা জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছায় তখন দেহকোষের জন্মহার কমে, সে তুলনায় বেড়ে যায় কোষের মৃত্যুহার। ফলে জীবনের শেষলগ্নে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে আমাদের পার্থিব শরীর।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে দেখেছেন কোষ বিভাজনের ফলে প্রতিদিন শতকরা এক থেকে দেড়ভাগ কোষসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। হ্যাঁ, সে হিসেবে আমাদের দেহের ওজন প্রতিদিন শতকরা এক থেকে দেড়ভাগ বেড়ে যাওয়া উচিত। এভাবে চললে ৯০ দিনেই আপনার ওজন আজ ৫০ কেজি হলে ৯০ দিন পর হবে ১০০ কেজি। পরবর্তী ৯০ দিনে ২০০ কেজি। না, আমি আর হিসেব করব না, আপনি নিজেই করে নিন। তবে এ ঘটনা শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, গাছপালা, পশুপাখি সবার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটলে কেমন দাঁড়াবে? সেনবাবু তার হিমালয়প্রমাণ শরীর নিয়ে কীভাবে ঢুকবেন মিসেস দাস-এর দশ ফুট বাই দশ ফুট ড্রয়িং রুমে।
না, ব্যাপারটা অত বিতিকিচ্ছিরি হচ্ছে না। কারণ, নেপথ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুনিপুণ মালিনী মৃত্যু। যে সুচারুরূপে জীবনের বাড়-বাড়ন্ত নিয়ত ছাঁটাই করে চলেছে দক্ষ হাতে। শুধু মানব সভ্যতার জন্য নয়, এই ধারিত্রীর সকল জীবের জন্য সব ক্ষেত্রেই। ইংরেজি সাহিত্যাকাশে অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র রোমান্টিক কবি পারসি বাইশী শেলী লিখেছেন- Death is here and death is there,
Death is busy everywhere all round, within, beneath, Above is death and we are death.
মৃত্যু এখানে আছে, মৃত্যু সেখানে আছে, সবখানেতেই মৃত্যুর ব্যস্ততা।
শুধু এলিট সাহিত্যে নয়, জীবনের নশ্বরতা ও মৃত্যুর অনিবার্যতা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে আমাদের গ্রাম্য লোককথায়। মনে পড়ে বানারহাটের নন্দাবৈষ্ঠোমীর সেই গান-‘আমার তাই তো ধন্দ লাগে গোঁসাইজি/ কী আশায় বান্ধিয়াছো ঘর/ তোর তো দন্ত পড়িবে, চুলও পাকিবে/ যৌবন লাগি যাবে ঘাটি/ দিনে দিনে পড়বে খসিয়া রঙ্গিলা দালানের মাটি/ ও গোঁসাইজি. . . ।’
সাধারণত আমরা পাঁচরকমভাবে মৃত্যু দেখতে পাই। অর্থাৎ মৃত্যুর কারণকে পাঁচ রকমভাবে ভাগ করতে পারি। যেমন- স্বাভাবিক মৃত্যু, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, আত্মহত্যা, খুন এবং আইনগত মৃত্যু। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে বা বয়সজনিত কারণে কোনো ব্যক্তির মরণ হলে তাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা হয়। পথ-যানবাহন ও বিভিন্ন দুর্ঘটনাতেও ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। কোনো ব্যক্তি যখন মানসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেই নিজের জীবন নাশ করে তখন তা আত্মহত্যা। কোনো ব্যক্তি যখন ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের জীবন শেষ করে তখন তা খুন। রাষ্ট্র বা প্রশাসন যখন কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ড দেয় তখন সেটা আইনগত মৃত্যু। বহু চর্চিত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি এক্ষেত্রে আইনগত মৃত্যু।
যেকোন মৃত্যু শোকের ছায়া বয়ে আনে। বাইরের ব্যক্তিদের কাছে না হলেও অন্তত তার নিকট-পরিজনের কাছে তো বটেই। তবে এই শোকের তীব্রতা নির্ভর করে বহু কিছুর উপর। যিনি চলে গেলেন তার বয়স। পূর্ণ বয়স্ক মানুষ চলে গেলে পারিপার্শ্বিক ব্যক্তিরা ততটা বেদনাবিধুর হন না, যতটা হন অল্পবয়সি কেউ মারা গেলে। কীভাবে প্রিয়জনের মৃত্যু হচ্ছে সেটাও খুব গুরত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন রোগে ভুগতে থাকলে আশপাশের মানুষজন অনাগত মৃত্যুর বিষয়ে মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু আকস্মিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। এক্ষেত্রে শোক হয় তীব্র।
প্রিয়জনের মৃত্যু যে দুঃখ নিয়ে আসে। তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা ব্যাপক বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ সাইকোলজিস্ট এই শোকের ব্যপ্তিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেন। আত্মীয়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে শোক তীব্রভাবে এসে হাজির হয়। এই তীব্রতা নির্ভর করে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ওপর। প্রথম পর্যায়ে তারা অবিশ্বাস করে যে তাদের প্রিয়জন আর তাদের কাছে ফিরে আসবে না। শোকবিহ্বল মানুষের মধ্যে এ সময় দ্রুত শ্বাস বইতে থাকা, গলা বন্ধ হয়ে আসা, অন্য কাজকর্মে অনীহা আশপাশের আত্মীয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, নিজেকে অপরাধী ভাবা, যখন তখন কেঁদে ওঠা এমন কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এসময় কেউ কেউ একেবারে শান্ত হয়ে যান। কথা বলেন না, উদাসীন ভাবে চেয়ে থাকেন। এইসব লক্ষণ কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে জানা গেছে- কান্না বা অশ্রুর মাধ্যমে শোক প্রকাশ করা সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত।
মাধ্যমিক স্তরে সবাই বুঝতে শেখে যিনি চলে গেছেন তাকে ছাড়াই বাকি সকলকে বাঁচতে হবে। তবুও মৃত ব্যক্তির প্রসঙ্গ আলাপ আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে। মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভিন্ন বিচার বিশ্লেষণ চলে। এই মধ্যবর্তী পর্যায় কয়েক বছর চলতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসে। জীবন আপন গতিতে এগিয়ে চলে সীমা থেকে অসীমের পানে। তবে সবকিছু নির্ভর করে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে শোকাতুর ব্যক্তির সম্পর্ক-নির্ভরতা কত গভীর ছিল তার ওপর।
মৃত্যুর আগে আমাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয় তা নিয়েও বহু গবেষণা চলেছে। যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা সবটাই স্বাভাবিক মৃত্যু সংক্রান্ত। দুর্ঘটনাজনিত বা আকস্মিক মৃত্যুকে এ ধরনের সমীক্ষা চালানোর যে সুযোগে নেই তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মৃত্যু পথযাত্রীদের মানসিক পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রকাশ দেখা গেছে। প্রথমে যখন কেউ বুঝতে পারে সে মরতে চলেছে তখন সে মনে মনে অস্বীকার করে। তার মনে আসে জীবিত লোকজনের প্রতি হিংসা ও ঈর্ষা। এর আর একটি রূপভেদ হল রাগ বা ক্রোধ। পরবর্তী সময়ে সে মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কখনও বা ভগবানকে ডাকে, কখনও বা ডাক্তারকে বলেন যত টাকা লাগে আমাকে বাঁচান। বাঁচার আকুল আকাঙ্খা বিভিন্ন রূপকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। মৃত্যুন্মখভাবে আজ বেঁচে গেলে সে আর কোনদিন মরবে না। চতুর্থ পর্যায়ে সে হা-হুতাশ করে, শোক-বিলাপ করে মৃত্যুর জন্য। সে ভাবে আরও কিছুদিন বাঁচতে পারলে অসমাপ্ত কাজগুলি শেষ করে যেতে পারত। একেবারে শেষ অবস্থায় সে ভয়শূন্য অনুভূতিহীন হয়ে যায়। সংসারের প্রতি কোনো টান থাকে না। মৃত্যু পথযাত্রীর এইসব মানসিক পর্যায় সবার ক্ষেত্রে সমান সময় ধরে চলে না। কারও ক্ষেত্রে দেখা যায় কয়েক মিনিটের মধ্যে পূর্ববর্তী ধাপগুলি পেরিয়ে শেষ অনুভূতিতে পৌঁছায়। কারও বা একটি পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। কেউ বা মনের অনুভূতি গোপন করে বাইরে বীরচিত ভাব প্রকাশ করে। তবে সবকিছু নির্ভর করে ব্যক্তির বয়স, শিক্ষা, দীক্ষা, সর্বোপরি জীবদর্শনের ওপর। মৃত্যুর মান সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। যেমন সেদিন আমার পাড়ার হিমাংশুর বাবা চলে গেলেন। শ্মশানে গিয়েছিল হিমাংশুর বন্ধু-বান্ধবেরা। আগে মারা গিয়েছিলেন সেই অমল মাস্টার। গোটা পাড়া ভেঙ্গে পড়েছিল। সেদিন রাতে আদর্শপল্লীর বহু বাড়িতেই হাঁড়ি চড়েনি। আর এমনটি হবে নাই বা কেন? সৎ, নিষ্ঠাবান-এই মানুষটিকে এলাকার সবাই আপদ-বিপদে কাছে পেয়েছে। কারও মৃত্যুতে শোকগ্রস্থ হয় পরিবার, কারও ক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রীয় শোক। তবে, এটা ঠিক যে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবার সঠিক মূল্যায়ন হবে; তেমন কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। মৃত্যুর বহু বছর পরেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম, কেউ কেউ বেঁচে থাকে আমাদের হৃদয় নিকেতনে।
মৃত্যুতেই যে জীবনের শেষ নয়। এটা যে নদীর ধারার মতো জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ সে কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সংকলিত গ্রন্থ ঋগ্বেদ। এই সুবিশাল গ্রন্থে ১০ তম মন্ডলে মৃত্যু সমন্ধে বহু কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই মন্ডলের বিভিন্ন সুক্ততে বলেছে, ‘আত্মা অবিনশ্বর অর্থাৎ পার্থিব শরীরে মৃত্যু এলেও, সুক্ষদেহী আত্মা বিনষ্ট হয় না।’
জীবন মৃত্যু ওতপ্রোতভাবে জড়িত তবুও চেতন-অবচেতনে মৃত্যুর আতঙ্ক আমাদের মনের মধ্যে জড়িয়ে থাকে। এই ভয় দূর করতেই হয়তো প্রাচীন মুণি-ঋষি বিভিন্ন মত প্রচার করেছেন। তরঙ্গ যেভাবে সাগর বক্ষে তৈরি হয়ে বেলাভূমিতে এসে বিলীন হয়। ঠিক সেভাবেই জীবন তরঙ্গের সাময়িক বিলোপ বা নিশ্চিহ্ন ঘটে মৃত্যুর সীমারেখায়। ঋগ্বেদের মতে শত শত মৃত্যুর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে আছে শত শত জন্ম বা নতুন জীবনের আশ্বাস। মৃত্যুর পর প্রেতপুরুষেরা অন্তরীক্ষ দিয়ে যমালোকে চলে যান। ঋগবেদের যম ও পুরাণে বর্ণিত যম একই ব্যক্তি নন। পুরাণের যম হল মৃত্যুর দেবতা। ঋগ্বেদের মতে বিবস্বানের দ্বারা সরেণ্যুর গর্ভে জন্ম হওয়া যমজ সন্তান হল যম ও যমী। যম ভাই এবং যমী বোন। বেদের প্রণেতারা বিবস্বান অর্থ, আকাশ ও সরুণ্য মানে ঊষাকালকে বুঝিয়েছেন। সে দিক দিয়ে যমজপুত্র- কন্যা হল দিন ও রাত। ঋগ্বেদে দিনের নাম যম, রাত্রির নাম যমী। আদিকালে ঋষিরা মনে করতেন পূর্বদিকেই জীবনের উৎসভূমি আর পশ্চিম পরলোকের দিক। কারণ, তারা দেখতেন দিনমণি দিবাকর রাতের আঁধারবৃন্ত ছিঁড়ে ফুটন্ত সকাল নিয়ে হাজির হন পূর্বদিগন্তে। পার্থিব জীবনের চালিকাশক্তি যে সূর্যালোকে এ সত্য হয়তো তারা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অনুধাবন করেছিলেন। সূর্যের পূর্ব-পশ্চিম পরিক্রমা, আসলে আমাদের জীবনের পথ পরিক্রমা করে পরলোকের পথে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
ঋগ্বেদের পরবর্তী সময় পৌরাণিককালে পরলোকের রাজা হিসেবে যমকে ব্যাখ্যা করা হয়। পিতৃলোকের অধিপতি তিনি পুণ্যকর্মের জন্য পুরস্কার ও পাপকর্মের সাজা দেওয়ার দায়িত্ব তারই হাতে। যম যমরাজ হয়ে যান। ঋগ্বেদের যুগে ঋষিরা বিশ্বাস করতেন- যারা পার্থিব জীবনে পুণ্যকাজ করেন তারা দেবদেবীদের সঙ্গে স্বর্গে বাস করেন। আর পাপীদের স্থান হয় নরকে। হ্যাঁ, সে সময় বুদ্ধদেববাবুর নিরপেক্ষ পুলিশ প্রশাসন ছিল না বলেই, হয়তো সামাজিক অনুশাসন রাখার জন্য ধর্মকেই তারা হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন।
ঋগ্বেদের পরবর্তী সময়ে উপনিষদীয়কালে মৃত্যুর পর পরলোক সংক্রান্ত বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মরণের পর বিদেহী আত্মা দুটি পথ ধরে চলতে পারে। একটি দেবযান বা উত্তরমার্গ, অন্যটি পিতৃযান বা দক্ষিণমার্গ। সগুণ ব্রহ্মের উপাসক, নৈষ্ঠিক ব্রক্ষচারী, বাণপ্রস্থী ও পঞ্চাগ্নিজ্ঞানসম্পন্ন গৃহস্থের মৃত্যুর পর দেবযানে গমন করেন। দেবযানে যারা যান তারা প্রথমে অর্চ্চি বা জ্যোতিঃকে পান। এরকম অর্চ্চি থেকে দিবা, দিবা থেকে শুক্লপক্ষ হতে আদিত্য থেকে চন্দ্রমা, বিদ্যুৎ এইসব বিভিন্ন লোক ঘুরে শেষে ব্রহ্মলোক বা সত্যলোকে পৌঁছান। সেখানে আত্মা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। মুক্তির পর আত্মাকে আর পার্থিব জগতে ফিরে আসতে হয় না। বেদ আরও বলছে ব্রহ্মজ্ঞানই আমাদের পার্থিব জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে পারে-
শৃন্বন্ত বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থুঃ।
বেদাহযেতাং পুরুষং মহান্তাম।
আদিত্যবনর্ণম তমসঃ পরস্তাৎ।
ত্বমেব বিদিতাহতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।
‘হে অমৃতের পুত্রগণ, যাঁরা দিব্যধামে আছেন আপনারা শুনুন- অজ্ঞানের অতীত, সূর্যের ন্যায় স্বপ্রকাশ, মহান পুরুষকে আমি জানি। তাকে জেনেই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়, এছাড়াও অমৃতত্ব লাভের অন্য কোনো পথ নাই।’
শ্রীমদ্ভগবদগীতার সাংখ্যযোগে মৃত্যুর ব্যাখ্যা অনেক সরল ও প্রাঞ্জল। মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, আত্মা সেইরূপ জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর গ্রহণ করে-
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহার
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।
অনেকের ধারণা প্রাচীনকালের মানুষেরা কয়েকশো বা হাজার বছর বাঁচত। এ ধারণাটি ঠিক নয়। সে সময়েও মানুষের সাধারণ আয়ু ছিল একশো বছর। কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতার ২য় কান্ডে তৃতীয় প্রপাঠকের ১১শ তম অনুবাদে পরিস্কার লেখা আছে- ‘ঋষি-মুণিরা সমাজের সকলের জন্য একশো বছর আয়ু প্রার্থনা করছেন।’ বৈদিক যুগেও জীর্ণ অসাড় দেহ দাহ করে তা পঞ্চভূতে লীন করা হতো।
মৃত্যু যদি শাশ্বত হয় তবে জীবনের অর্থটাই বা কী। হাত-পা ছড়িয়ে ঈশান কোনে চেয়ে বিবেকবাবুর মতো গুনগুনিয়ে গান ধরব- ‘মন চল নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে . . .।’ না, এই সংসার প্রদেশে আমরা বিদেশী নই। এটাই আমাদের কর্মভূমি। মৃত্যু আছে ঠিকই, তবে জীবনও অক্ষয়। কবীর জোলার সেই কথাটাই মনে পরে- ‘জগতে তুমি যখন এসেছিলে তখন তুমি কেঁদেছিলে, আর তোমার চারপাশের প্রিয়জনেরা হেসেছিল। আর তুমি যখন জগত ছেড়ে যাবে তখন যেন হাসতে হাসতে যেতে পারো, তোমার পরিচিত সবাই যেন আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।’ আপনার জীবন ততটাই সার্থক, চিরবিদায়ের সময় আপনি যত বেশী মানুষকে কাঁদিয়ে যেতে পারবেন।
তাই তো মৃত্যু প্রসঙ্গে উনিশ শতকের অত্যন্ত জনপ্রিয় আমেরিকান কবি হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লং ফেলো বলছেন-
There is a Reaper,
whose name is Death,
And with his sickle keen,
He reaps the bearded grain at a breath,
And the flowers that grow between.-
সেখানে আছে সেই শস্য ছেদনকারী, যার নাম মৃত্যু। সে তার ধারালো কাস্তে দিয়ে জীবনের সব প্রস্ফুটিত মঞ্জরী ও ফসল কেটে নেয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
হ্যাঁ, কবিগুরুর সোনারতরীতেও একই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। আমাদের জীবনের যা কিছু সৃষ্টি, সেই রাশি রাশি ভারা ভারা ধান, সময়ের তরী বেয়ে পৌঁছে যায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। আর আমরা জীবনাবসানে চলে যাই মৃত্যুর অতলান্ত গহ্বরে। সে কারণেই এক অনামি কবি লিখেছেন-
‘মৃত্যুর সমুদ্র মাঝে জীবনের তরঙ্গ উছল,
বীজের মরণ আনে অঘ্রানের সোনালি ফসল।’
শোনা যায়- প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জরা, ব্যাধি মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে এক রাজপুত্র রাজ্যপাট ছেড়েছিলেন, ত্যাগ করেছিলেন সুন্দরী স্ত্রী ও শিশুপুত্রের সঙ্গ। এত কিছুর পরেও তিনি মৃত্যুকে এড়াতে পারেননি। আশি বছর বয়সে কুশিনগরে তার পার্থিব শরীর নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। তবে তিনি এখনও প্রাণবন্ত; দুনিয়ার সব শান্তিকামী মানুষের অন্তরে, তথাগত আজও উদবেল শ্বেত কপোতের ডানায় ডানায়। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়। সে বলে - ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন নাহি যেতে চায়. . .।’ মানুষের এই বাসনাকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে এক মজার কারবার শুরু করেছে কিন্তু বায়োটেকনোলজিক্যাল কোম্পানি। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে তারা বোঝাতে চাইছেন-‘যে তালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগিয়ে চলেছে তাতে আগামী দিনে মরা মানুষকে বাঁচানোর কলাকৌশল বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করে ফেললেন বলে।’ আপনি যদি কোন মতে লাখ সত্তর টাকা জোগার-যন্ত্র করে এইসব কোম্পানিতে জমা দিতে পারেন তাহলে আর চিন্তা নেই। মৃত্যুর পর ব্রেন ডেথ হওয়ার আগেই আপনার পার্থিব দেহটিকে এরা রেখে দিবে হিমায়িত অবস্থায়। এখানকার তাপমাত্রা- ১২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বিজ্ঞানের ভাষায় একে ঠিক হিমায়িতকরণ বা ফ্রিজিং বলে না, ভিট্রিফিকেশন বলা হয়। এই অবস্থায় দেহ শুধু যে পচনমুক্ত থাকবে তাই নয়, দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বছরের পর বছর থাকবে অবিকল আগের মতো। দেহটিকে নিয়মিত দেখভাল করবে জীবপ্রযুক্তিবিদরা। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই প্রযুক্তিকে বলে ক্রায়োনিকস।
বিজ্ঞানীরা মরা মানুষ বাঁচানোর পদ্ধতি পুরোপুরি আবিস্কার করলেই আপনাকে বাঁচিয়ে তোলা হবে। তা পনেরো-কুড়ি যত বছর পর হোক না কেন। যদি দরকার পরে তবে মেরামত করে দেওয়া হবে। আপনার নেফ্রাইটিস আক্রান্ত কিডনি বা সিরোসিস হওয়া লিভারটি। থোবরা ভাঙ্গা মুখের বলিরেখাগুলি ভ্যানিস করে দেবে কসমেটিক সার্জেন। আর কী। ডু ফুর্তি। গলফ খেলুন আপনার নাতি নাতনির সঙ্গে।
‘না বাপু, কর্পদশূন্য হয়ে আবার বেঁচে উঠে করবোটাই বা কী? সকাল-বিকাল নাতির বউয়ের মুখ ঝামটা খাব?’- সে দুঃশ্চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি। তারা চালু করেছে পুনর্জীবন বিমা। সামান্য কিছু প্রিমিয়াম দিয়ে যান, যতদিন না পটল তুলছেন। তারপর আবার বেঁচে উঠলে হাতে পেয়ে যাবেন কয়েক লক্ষ ডলার। আর কী, লাগ যা গলে দিলরুবা। মরিশাসের নীল সমুদ্দরের বেলাভূমিতে প্রীতি জিন্টার নাতনির হাত ধরে হেঁটে বেড়ান। গলা ছেড়ে গান ধরুন- ‘চলো না. . . রড্রিগসের সৈকত ছেড়ে . . .পাইন বনের ছায়ায়. . . শুরু হোক পথ চলা . . . শুরু হোক কথা বলা . . .।’ ইতিমধ্যে আরব দুনিয়ার বহু ধনকুবেরের ও ইউরোপ আমেরিকার বেশ কিছু শিল্পপতি ক্রায়োনিকস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
মাল্টিমিলিয়নারদের তালে আমাদের তাল দিলে তো চলবে না। আসুন মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতায় ফিরে আসি। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু আমরা পৌঁছে যাব মৃত্যুর শান্ত শীতল কোলে।
মৃত্যু জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জীবনের ধারক ও বাহক। তাই হয়তো ছয় ফুট লম্বা আলখাল্লা পড়া, দাড়িওয়ালা ওই মানুষটি ছন্দে ছন্দে সারকথা বলেছেন-
মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’, রাত বলেছে যাই. . . ভুবন বলে, ‘তোমার তরে আছে বরণমালা।’
গগন বলে, ‘তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা।’ প্রেম বলে যে, ‘যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে।’
মরণ বলে, ‘আমি তোমার জীবন তরী বাই।’
একের মধ্যে বহু; শ্রীপদ দাস; ২৬ বর্ষ ৭৯ সংখ্যা শুক্রবার ১৯ শ্রাবণ ১৪১২ উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
গত ৩১ জুলাই, ২০০৫ তারিখে উত্তরবঙ্গ সংবাদের রবিবারের সাময়িকী-র পূর্ণ পৃষ্ঠায় মৃত্যু সম্পর্কিত একটি চিরকালীন অনন্ত জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজেছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম তাঁর ‘মরণ রে’ লেখায়। লেখাটিকে প্রবন্ধ বা নিবন্ধ বলে অভিহিত করার বদলে ‘রচনা’ বলছি। কারণ, রচনায় থাকে সৃজন বা নির্মাণের শৈলী। পাঠকমাত্রেই তাঁর এই অন্বেষণ যাত্রায় যাত্রা-সহচর হয়েছি আমিও। মৃত্যু বিষয়ক কিছু প্রবন্ধ ও পুস্তক-রাজি পড়ার সমান্য সুযোগ হয়েছে আমার। বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদদের এ সম্পর্কিত মতবাদকে অল্প বিস্তর জানার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু আলোচ্য রচনাটি একটি সম্পূর্ণ রচনা। (অংশকে ছাপিয়ে পূর্ণকে স্পর্শ করেছে বলেই)। রচনাটির নির্মাণে পাঠক যেমন পেলেন একজন বিজ্ঞানী, জীব-বিজ্ঞানী, সমাজ-বিজ্ঞানী, পুরাণবেত্তা, সাহিত্যিক-কে একসঙ্গে তেমনি পেলেন একজন জীবন-রসিক মহিমময় রচনাকারকে। ডাঃ পার্থপ্রতিম এখানে ‘একের মধ্যে বহু’ আর এখানেই তিনি অনন্য। সার্থক।
আজকের আকাশ-শাসিত যুগে ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চা থেকে অনেক দূরে আমাদের নিঃসঙ্গ অবস্থান। সেখানে টেনিসন, গিটারম্যান, শেলি, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ এর কালজয়ী কবিতার পংক্তি নির্যাস আমাদের স্মরণে এনেছেন। এ তো মহার্ঘ উপহার ! তিনি মৃত্যুকে চিনিয়েছেন অন্যতর এক দ্যোতনায়, মমতায়। মৃত্যুর রূপ ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে করতে তিনি নিজ দক্ষতায় পাঠককে উত্তীর্ণ করেছেন মৃত্যু-উত্তর এক ভিন্নতর বোধে, বোধের গভীরে। মৃত্যু-কথা শেষ করে জীবনের জয়গানে তিনি মুখর হয়েছেন। আর এখানেই অপরাপর রচনা থেকে এ রচনার উৎকর্ষ নির্দিষ্ট হয়ে যায় অলক্ষ্যে। তবে উদাহরণের জন্য নাত-বৌ, প্রীতি জিন্টাদের উপস্থিতি বিষয়ের গুরুত্বকে গুরুত্বহীন করেছে বলেই মনে হয়েছে। এতে অনেকটাই ধ্বস্ত হয়েছে রচনার আন্তঃ নির্মাণের ঠাসবুনুট।
পরিশেষে বলব-এ রচনায় মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের যাবতীয় অন্ধ, মূঢ়, সংস্কারকে তিনি ভেঙ্গেছেন। ধন্যবাদ ডাঃ পার্থপ্রতিম।
শ্রীপদ দাস
হাকিমপাড়া, শিলিগুড়ি।