হৃদয় দিয়ে রুখতে হবে পরিবেশ দূষণ

হৃদয় দিয়ে রুখতে হবে পরিবেশ দূষণ

হৃদয় দিয়ে রুখতে হবে পরিবেশ দূষণ; ৮ম বর্ষ ১৭৪ সংখ্যা মঙ্গলবার ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৯; বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত
শান্ত-দীপ্ত চেহারা, পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, গালে শুভ্র দাড়ি। সাদা ফেট্টিতে ঢাকা পড়েছে কাঁচা পাকা চুল। বয়সের বলিরেখা মুখে ছাপ ফেললেও, সবুজ মনে দাগ কাটতে পারেনি। হিমালয়ের কুমায়ুন গাড়োয়াল পাহাড়ি অরণ্যের নাম জানা- না জানা গাছ গাছালির ফাঁকে যে নামটি দমকা হাওয়ার ঝড় তুলে চলছে, তিনিই চিপকো আন্দোলনের জনক সুন্দরলাল বহুগুণা। আজ তাঁর একটি অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হল বিজ্ঞান বিচিত্রায়।

ডাঃ পার্থপ্রতিমঃ-আপনি এই পরিবেশ আন্দোলনের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
সুন্দরলাল বহুগুণাঃ- আমি একজন সাধারণ গ্রামবাসী। হিমালয় অঞ্চলেরই সন্তান। এই অতন্দ্র পর্বত থেকে ভারতের আদর্শ নদী গঙ্গার উৎপত্তি। জাহ্নবী ও হিমালয় ভারতবর্ষে সংস্কৃতির প্রেরণা। জীবন হল সৃজনশীল কাজ। যেখানে জাতি আছে সংস্কৃতি আছে। হিমালয়ের বনভূমি আজ বিরাট বিপদের সন্মুখীন। হিমালয়ের সঙ্কট কেবল হিমালয়কেই শেষ করবে না, সমগ্র দেশের সংস্কৃতি ও জনজীবনকে বিধস্ত করবে। এই বিধ্বংসী সঙ্কটকে রুখে দেবার তাগিদই শুধু আমাকে নয় সারা গাড়োয়ালের মানুষজনকে পরিবেশ আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ডাঃ পার্থপ্রতিমঃ-ভারতের বনাঞ্চলের সঙ্কট কতটা ভয়াবহ?
সুন্দরলাল বহুগুণাঃ- অরণ্যের পরিমাণ এদেশে খুবই কম। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যকর ও নির্মল পরিবেশের জন্য মোট জমির ৩০ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বনাঞ্চলের পরিমাণ ৬.১ শতাংশ (স্যাটেলাইট সার্ভে রির্পোট অনুসারে)। ভারতের মাথাপিছু গড় অরণ্যের পরিমাণ ০.১১ হেক্টর। তুলনামূলকভাবে থাইল্যান্ডে ০.৫০ হেক্টর। গাছকাটা থাইল্যান্ডে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু, ভারতবর্ষে এখনও ব্যাপকহারে অরণ্য ধ্বংস চলছে। বর্তমানে শিল্প ক্ষেত্রে কাঠের চাহিদা বছরে ২.৮ কোটি ঘন মিটার। কিন্তু ভারতে অরণ্যের বার্ষিক বৃদ্ধি ১.২ কোটি ঘন মিটার। বিভিন্ন গবাদি পশুর খাদ্য হিসাবে প্রতি বছর ৯৩ কোটি টন সবুজপাতা ও ৭৮ কোটি টন শুকনো খড় প্রয়োজন। বনজ সম্পদ থেকে সাধারণভাবে ২৫ কোটি টন সবুজ ও ৪২ কোটি টন শুকনো পশুখাদ্য পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে প্রতি বছর ২৩.৫ কোটি টন বনজ কাঠ, ডালপালা পোড়ানো হয়। কিন্তু এদেশে জ্বালানি কাঠের স্বাভাবিক উৎপাদন ৯ কোটি টন। এ ফারাকগুলি পূরণ করা হচ্ছে অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক উপায়ে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে নিঃশোষিত হবে প্রাণ শক্তি।
    গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য প্রতিবছর ৬০০ কোটি টন ভূমিক্ষয় হচ্ছে। যারমধ্যে উদ্ভিদের বিভিন্ন পুষ্টি দ্রব্য রয়েছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, এই পুষ্টিক্ষয় রাসায়নিক সার দিয়ে পূরণ করতে গেলে ২,৪০০ কোটি টাকার প্রয়োজন।

ডাঃ পার্থপ্রতিমঃ-অরণ্য সংরক্ষণ করতে সরকারি উদ্যোগ কতটা আশা জাগাতে পারে?
সুন্দরলাল বহুগুণাঃ- সরকারি পরিকল্পনা খুবই জটিল ও কুয়াশাচ্ছন্ন। ব্রিটিশ শাসনকালে জাহাজ নির্মাণ, রেলপথের স্লিপার তৈরি, চা-নীল চাষের জন্য ব্যাপকভাবে অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে। তবুও বনাঞ্চলগুলির উপর অলিখিত মালিকানা ছিল স্থানীয় গ্রামবাসীদের। অরণ্যবাসীরা গাছকে জীবনের অঙ্গ বলেই মনে করত। আজও বহু উপজাতির মধ্যে বৃক্ষ পূজা , বনবিবির আরাধনা, বৃক্ষরোপণ উৎসবের সংস্কৃতি চোখে পড়ে। স্বাধীনতালাভের পর বনজ সম্পদ সরকারি সম্পত্তি হয়ে যায়, অরণ্যবাসী মানুষের সেখানে অধিকার নেই। আছে চোরাকারবারী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য।

ডাঃ পার্থপ্রতিমঃ- এসব আছে ঠিকই। তবে সরকারি পক্ষ থেকে সমাজভিত্তিক বনসৃজন প্রকল্পও তো নেওয়া হয়েছে?
সুন্দরলাল বহুগুণাঃ- একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে সমাজভিত্তিক বনসৃজন প্রকল্পে যেসব গাছ লাগানো হচ্ছে, তার বেশিরভাগ ইউক্যালিপটাস জাতীয়। এই গাছগুলি পালপ, প্লাইউড ও কাগজ শিল্পের কাঁচামাল। অভিজাত মহলের প্রয়োজন মেটায় ঠিকই, তবে সাধারণ গ্রামবাসীদের উপকারে আসে না। এছাড়া কিন্তু কুফল আছে। যেমন, মাটির জলস্তরকে নীচে নামিয়ে দেয়, গবাদি পশু এ গাছের পাতা খায় না, কীটপতঙ্গ ও পাখি গাছগুলিতে বাসা বাঁধে না, সামগ্রিকভাবে কোনও বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে না। ভারতবর্ষের প্রায় তিন চতুর্থাংশ শিশু খাদ্য ও ভিটামিনের অভাবে অপুষ্টির শিকার। আম, জাম, কাঁঠাল গাছ লাগালে ক্ষতি কি? ছেলেরা খেয়ে বাঁচে।

ডাঃ পার্থপ্রতিমঃ- তেহরি ড্যাম তৈরির কাজে আপনারা বিরোধিতা করছেন কেন?
সুন্দরলাল বহুগুণাঃ- দেরাদুন জেলায় যমুনা নদীর উপর লেহাওয়ার বাঁধ ও গাড়োয়াল জেলায় ভাগীরথী নদীর ওপর তেহরি বাঁধ প্রকৃতির কাছে জ্বলন্ত অভিশাপ। জলসেচের জন্য নির্মীয়মান তেহরি বাঁধ ৪৫ কিলোমিটার লম্বা ও ২৬০ মিটার উঁচু; এটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। এই ড্যাম হলে জলাধারের বিস্তৃত এলাকা জলমগ্ন হবে। নিশ্চিহ্ন হবে বহু প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করলে বিশাল জলরাশির চাপে ভূ-স্তরে ফাটল ধরে। ওই ফাটল পথে জলাধারের জল পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, বাষ্পায়িত হয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ঊর্ধ্বমুখী চাপের সৃষ্টি করে। এরফল হিসাবে ভূমিকম্প হয়। ১৯৬৭ সালে মহারাষ্ট্রের কয়নানগরে কয়নাবাঁধের জলাধারের চাপে, এই ধরনের বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই ভূ-কম্প প্রবণ। ভূত্ববিদেরা বলেছেন, ভূমিকম্পের তীব্রতা ৭ রিখটারের বেশি হলে তেহরি বাঁধ থেকে ব্যাপক ধ্বংসের আশঙ্কা রয়েছে। এই ধ্বংসাত্বক শক্তির পরিমাণ হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার চেয়ে ১০ গুণ বেশি হবে। তেহরি বাঁধের ফলে গঙ্গাও নির্জীব হয়ে পড়বে।

ডাঃ পার্থপ্রতিমঃ- গঙ্গা দূষণ রোধে গৃহীত সরকারি ব্যবস্থাগুলি কতটা কার্যকরী?
সুন্দরলাল বহুগুণাঃ- গঙ্গা পৃথিবীর বৃহত্তম নদীগুলির অন্যতম। হিমালয়ের উৎসমুখ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য২,২২৫ কিলোমিটার। ভারতীয়রা গঙ্গা নদীর জলকে পবিত্র বলে মনে করে। কিন্তু বর্তমানে নদীটি চূড়ান্ত অপবিত্র হয়ে গেছে। গঙ্গা এখন কলেরা, টাইফয়েড,অ্যামিবায়োটিক ডিসেন্ট্রি, প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল হেপাটাইটিসের জীবাণু বহন করে চলছে। গরমকালে গঙ্গার পার্শ্ববর্তী কলকাতা, হাওড়া, ও হুগলি অঞ্চলের প্রায় ৪০ শতাংশ লোক অ্যামিবায়োটিক ডিসেন্ট্রির কবলে পড়ে।
    এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশেই ৮৬টি বড় শিল্প কারখানা গঙ্গার জলে বিভিন্ন বিষাক্ত মিশিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে ৬৬টি রয়েছে কানপুরে। পশ্চিমবঙ্গে ৪৩টি বৃহৎ কারখানা একই কাজ করে চলছে। বেনারসে গঙ্গাতীরে প্রতিদিন প্রায় ৪০০টি মৃতদেহ সংস্কার করা হয়। এছাড়াও বছরে ন’হাজারের বেশি গবাদি পশুর মৃতদেহ ভাসানো হচ্ছে এ নদীতে।
    কয়েকদিন আগে ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’ তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে নদ-নদীর জলদূষণ অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। শুধু গঙ্গা নদীর তীরেই ৫০ হাজার বা তার বেশি সংখ্যক মানুষের শহর রয়েছে ১১৪টি। বৃহত্তর কলকাতার দুই তৃতীয়াংশ ময়লা জল সরাসরি এই নদীতে মিশছে।
    সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এর বেশির ভাগ টাকাই জল বাঁচানোর নামে জলেই দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আসছে। এই সরকারি প্রকল্প অনেকটা গোড়া কেটে গাছের মাথায় জল দেওয়ার মতো। দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলি দূষণ করেই চলছে। পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হলে চাই জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টা। সাধারণ মানুষকে দূষণের মারাত্মক পরিণতি সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে। সচেতনতার অভিযান হবে ভারতবাসীর ধর্মীয় আবেগ ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ রেখেই, যা তারা সহস্র বছর ধরে বহন করে চলছে। যে ভাববাদ আপামর জীবকূলের মঙ্গল আনে তা ধ্বংসাত্মক বস্তুবাদের চেয়ে অনেকবেশি গ্রহণীয়। শুধু অর্থ দিয়ে হবে না, চিত্ত দিয়ে রোধ করতে হবে পরিবেশ দূষণ।              
Environmental pollution will be prevented by heart. Dr. Parthapatim's was published in the Bartaman daily, with an intimate interview of Sunderlal Bahuguna, the originator of Chipko movement.

Join our mailing list Never miss an update