‘বানারহাট’ নগ-বনানীর অপূর্ব মিশেল; ডাঃ পার্থপ্রতিম;উত্তরভূমি’ পত্রিকার মার্চ ২০০৬ সংখ্যায় প্রকাশিত
বর্ষা রাতের শেষে চা-বাগিচার সবুজ গালিচায় আছড়ে পড়া সোনা রোদের আভা, অদূরেই মাথা তোলা হিমালয়, যৌবনমদে মত্ত পাগলাঝোরা, অলস পায়ে হেঁটে চলা বুনো হাতির দল। এ সবই ডুয়ার্সের পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ।
হ্যাঁ, এ সবের বাইরেও বানারহাটে রয়েছে আরও বহু আকর্ষণ- যা শুধু ভ্রমণবিলাসীদের নয়, ছাপোষারও মন কেড়ে নেবে। শিলিগুড়ি থেকে আলিপুর জংশনগামী ট্রেনে চা-বাগিচার কোলে ছোট সুন্দর বানারহাট রেল স্টেশন। শিলিগুড়ি টাউন, শিলিগুড়ি জংশন হয়ে বানারহাটে পৌঁছায় সকাল সাড়ে ন’টায়। ভাড়াও তেমন কিছু নয়, ১৮ টাকা মাত্র। ট্রেনের যাত্রাপথও খুব মনোরম। অজস্র নদী, চা বাগান জঙ্গলের বুক চিরে চলতে থাকবে রেলগাড়ি। পথে রয়েছে দু'-দুটি টানেল। গা-ছমছমে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে কু-ঝিকঝিক ঝমঝম। এছাড়া শিলিগুড়ির পি.সি.মিত্তাল বাস টার্মিনাস থেকেও সকাল-বিকাল বানারহাটে আসার অনেক বাস রয়েছে। সেভকে তিস্তা নদীর ওপরে থাকা কারোনেশন ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ি পথ ধরে বেশ কিছুক্ষণ ছুটে চলবে আপনার গাড়ি। একপাশে খাড়া পাহাড়, অন্যপাশে নদীখাদ। অদ্ভুত রোমাঞ্চ ছড়িয়ে যাবে আপনার শিরা-ধমনিতে। তারপর ওদলাবাড়ি, মালবাজার, চালসা হয়ে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পৌঁছে যাবেন বানারহাটে। সেক্ষেত্রে বাস ভাড়া তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি, ৪৫ টাকা।
বানারহাটে নিশিযাপনে বেশ কয়েকটি আস্তানা রয়েছে। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই রয়েছে সেচ ও জলপথ দপ্তরের পরিদর্শক বাংলো। এরই কাছে পঙ্কজ লজ। স্টেশন রোডে থাকা সানসাইন লজে খুব অল্প খরচে থাকতে পারেন। চামুর্চি মোড়ে তৈরি হওয়া কৃষ্ণা লজ বিলাস বহুল, ঝাঁ চকচকে।
বানারহাট থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত গ্রাম চামুর্চি। চামুর্চি থেকে হাঁটাপথে পাহাড়ি পাকদণ্ডী ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় মহাকাল মন্দিরে। বর্ষাকালে এ পথ খুবই দুর্গম হয়ে ওঠে। তাই শীতের সময় যাওয়াই ভালো। বানারহাট থেকে সকাল সকাল রওনা দিলে সন্ধ্যার আগে বানারহাট ফিরতে পারবেন। পাহাড়ে ট্রকিং করা যাদের নেশা, এ পথ তো তাদের স্বর্গরাজ্য। আপনার ভেতরে যদি একটি রোমাঞ্চপিয়াসী মন থাকে তবে অপ্রচলিত পথে মন্দিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালে পাহাড়ের গুহার ভেতর নেমে এসেছে পাথরের তৈরি লম্বা লম্বা শিবের জটা। এ গুলি আবার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জটা থেকে অবিরাম টুপটাপ ঝরে পড়েছে জলবিন্দু। এই জলে রয়েছে কিছু দুরারোগ্য চর্মরোগ আরোগ্য করার ক্ষমতা। ভূ-বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় এ গুহাকে বলে স্ট্যালাকটাইট স্ট্যালাগমাইট কেভ (stalactite - stalagmite cave)। চুনাপাথর বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে পাহাড়ি আম্লিক জলের রাসায়নিক ভাঙাগড়ার খেলা চলে এই আঁধারঘেরা গুহায়। মহাকাল পাহাড়ের পাশেই চলছে ডলোমাইট সংগ্রহের খাদ খনন। এর নীচেই দেখতে পাবেন ছোটো সিমেন্ট ও সার কারখানা।
চামুর্চির অদূরেই রয়েছে ভুটানের জেলা শহর সামচি। রাজকীয় সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকলেই এক সব পেয়েছির দেশ। আকাশপানে হাত বাড়ানো শ্যামল নগচূড়া, নাম না জানা, না জানা জংলি ফুলের ঝাড় ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ‘দ্য আইরিসেস’কেও হার মানায়। সামচি রাজকীয় হাসপাতাল ছিমছাম গোছানো। চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনেই রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ প্যাগাড্ডো। স্বর্ণালিবর্ণের সুবিশাল বৌদ্ধমূর্তির পাদদেশে জ্বলছে শত শত আলোক দীপমালা। আপনার হাতের ছোঁয়ায় ঘুরতে থাকবে কালচক্র। সামচি ডাকঘরে থেকে সংগ্রহ করতে পারেন রং বেরঙের সব ডাকটিকিট। ডাকটিকিটের বৈচিত্র্য ভুটানের নাম জগতজোড়া। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুন্দর মিউজিয়ামে পাথরের বুকে এঁকে যাওয়া কালের ছাপ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
সামচিতে দেখতে পাবেন ড্রুক কোম্পানির ফুড প্রসেসিং কারখানা। জ্যাম, জেলি, আচার তৈরি হচ্ছে কমলা, আনারস, পেয়ারা ও নানান ফল-সবজি দিয়ে। ভুটান আর্মি ওয়েলফেয়ার প্রোজেক্টের রয়েছে সামচি ডিস্টিলারি। এখানেই বোতলবন্দি হচ্ছে বিভিন্ন ভুটানি সুরা। সামচি বাজারে যত্রতত্র ছড়ানো রয়েছে কাফে, বার। স্বল্প পয়সার বিনিময়ে আপনার পান পেয়ালায় উপচে পড়বে ভুটানি হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, রাম। থুড়ি, এটা শুধু বাউন্ডুলে বোহেমিয়ানদের জন্য।
বানারহাটে গোল্লাছুটের খুঁটি করে ঘুরতে পারেন ডায়না ও রেতি ফরেস্ট। ডায়না নদীর তীর ধরে উত্তরে হেঁটে যাওয়া আর দূরে তাকিয়ে দেখা- 'যেথা আকাশ মাটিতে কানাকানি'। শীত পড়লে নদীচরে ভীড় জমায় বনভোজনের দল। প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র জোগাড় করে বিন্নাগুড়ি সেনানিবাসও ঘুরে আসতে পারেন। অনুমতি নিতে হবে জি.ও.সি. বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট-এর কাছ থেকে। এখানে ঢুকলে সচিত্রপরিচয় পত্র সব সময় কাছে রাখবেন।
তেলিপাড়া চা-কারখানার কাছেই ভূ-গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা প্রস্রবণ তৈরি করেছে আংরাভাসা নদী। সুবিশাল জায়গা জুড়ে মাটির তলদেশ থেকে জলের বুদবুদ উঠতে থাকে সারা বছর। বছর ভর দেখতে পাবেন ব্যাঙাচি থেকে ব্যাঙের রূপান্তর। তেলিপাড়া ড্রাগ ফার্মে এখন চলছে মাশরুম চাষ।
বানারহাট থেকে গয়েরকাটার দূরত্ব ১২ কিমি। এখান থেকে নাথুয়া যাওয়ার পথে মধুবনী নদীপাশে জলপাইগুড়ি জেলাপরিষদের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে মধুবনী ইকোটুরিজম পার্ক।
‘আরণ্যক’ নামের পরিবেশকেন্দ্রিক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই এ প্রকল্প তৈরির দাবি জানিয়ে আসছিল। পার্কের অপর পাশেই খুট্টিমারি অরণ্য। বনের ভেতর দিয়ে পাঁচ কিমি পথ গেলেই রাভা জনজাতির খুকলুং বস্তি। এখানকার ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দিঘির পানে চেয়ে পড়ন্ত সূর্যের আভায় দেখতে পাবেন বানর, হরিণের চকিত চাহনি। শুনতে পাবেন বালিহাঁস ময়ূরের কলকাকলি। পথ চিনতে অসুবিধায় পড়লে যোগাযোগ করতে পারেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে তৈরি গয়েরকাটার দুই প্রকৃতিপ্রেমী যুবক বিনায়ক বোস ও কানাই চ্যাটার্জি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই এদের নেশা।
বন বিভাগের তৈরি বানারহাট শিশুউদ্যান ছোটোর মধ্যে সুন্দর। কৃত্রিম পাহাড়ের গা ঘেঁসে থাকা জলাশয়ে রয়েছে কমল কুসুম। শীতের দুপুরে কমলার স্বাদ ও ঘ্রাণ আপনার বলাকা মনকে নিয়ে যাবে দূর অজানার স্বর্গীয় কল্পলোকে। বানারহাট কালীবাড়ি প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। আদ্য শক্তির মন্দির ছাড়াও পাশাপাশি রয়েছে সত্যসাঁই বাবা, শিব পূজাভূমি।
মন্দির প্রাঙ্গণে তৈরি হয়েছে ডুর্য়াসের অন্যতম ঘূর্ণায়মান নাট্যমঞ্চ। এ মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মেঘনাথ ভট্টাচার্য, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, গুরুদাশ বন্দোপাধ্যায় সহ আরো বহু খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী। বাইশটি চা বাগানের বন্দর মফম্বল বানারহাট। প্রতি রবিবার এখানে বিরাট হাট বসে। চা-বাগিচা ও বস্তি অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ক্রেতা- বিক্রেতা এখানে বেচা-কেনা করে। বহু মানুষের আসা-যাওয়ায় হাটটি সরগরম। উওরের স্বনামধন্য কবি অমিতকুমার দে তাই হয়তো লিখেছেন-
‘‘জম-জমাট আসর জমায় রবিবারের হাট/ কুলি-কামিন রাখরে তুলে পাতা তোলার পাট/ এদিনটাতে বলবে না কেউ-সকাল থেকেই খাট/ বানারহাটের হাট জমাতে সকলে ফিটফাট।...
বানারহাটে পাওয়া যাবে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাওঁ, মাহালি, বরাইক, প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এক মিশ্র সংস্কৃতি। এদের সরলতা, নীতিবোধ, অল্পে সুখী হওয়ার মানসিকতা, সব মানুষকে বিশ্বাস করার স্বাভাবিক প্রবণতা সকলের মন কেড়ে নেবে। আপনারও মনে হবে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর শ্রেষ্ঠ সুকুমার কলার চর্চা সংগঠিত হয়েছে এদের মন-হৃদয়-অনুভবে।