আসুন পোকা খাই

আসুন পোকা খাই

আসুন পোকা খাই; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৩১ মার্চ ১৯৯৫; সানন্দা পত্রিকায় প্রকাশিত
সেই বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিকদের ছড়াটা নিশ্চয় মনে আছে- খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে। খাওয়ার আজব খাওয়া... ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই।
জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ ঝুঁকেছে নতুন নতুন খাদ্য উৎপাদনের দিকে। এমনকি এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই খাবারের টেবিলে চলে এসেছে বিভিন্ন ধরনের কীট-পতঙ্গ। না-না পাশ্চাত্য দেশে নয়, প্রাচ্যের বহু লোকই পতঙ্গ থেকে তৈরি বিভিন্ন খাবার তৃপ্তির সঙ্গেই খাচ্ছেন।
আর্থ্রোপোডা বা সন্ধিপদ পর্বের পতঙ্গ শ্রেণীর প্রাণীরা বিশাল এই প্রাণী জগতের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে আছে। প্রোটিন ও স্নেহ পদার্থে ভরপুর পোকারা বহু প্রাণীরই খাবার তালিকায় রয়েছে। জীব বিজ্ঞানীরা দেখেছেন- মাছের খাদ্যের শতকরা ৪০ ভাগই হল জলজপোকা। এছাড়া টিকটিকি, গিরগিটি, গোসাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি প্রাণীরা পতঙ্গ ও লার্ভাকে খেয়ে থাকে। এমন কী পতঙ্গভুক উদ্ভিদও দেখা যায়। যারা পাতা বা দেহের কোন অংশকে ফাঁদে পরিণত করে কীট পতঙ্গকে বন্দী করে। তারপর তাদের দেহ থেকে শুয়ে নেয় প্রোটিন জাতীয় খাদ্য। মানুষও যে পতঙ্গভুক হিসাবে এগিয়েই রয়েছে তা নেহাৎ অকারণে নয়। একে তো পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই পতঙ্গ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তাছাড়া এদের সংগ্রহ করাও সহজসাধ্য। পতঙ্গ প্রোটিন, ফ্যাট ও শক্তির উৎস হিসাবে আমাদের অন্য সব খাবারের সঙ্গে জোরদার পাল্লা দিতে পারে।

মার্কিন মুলুকে শিকাগো অঞ্চলের অধিবাসীরা গ্রাইল্লাস অ্যাসিমিলস বৈজ্ঞানিক নামের ঝিঁ-ঝিঁ পোকাকে খাবারের টেবিলে এনেছেন। এই কালো-বাদামি পতঙ্গকে প্রথমে তাঁরা আগুনে ঝলসে নেয়, তারপর মাখন ও লবণ লাগিয়ে পরিবেশন করেন। ক্যারিবিয়ান সাগরের সুনীলজলের মধ্যে ছোট্ট দ্বীপ জামাইকা। এখানকার লোকেরা গণ্যমান্য অতিথিদের এই ঝিঁ ঝিঁ পোকা খেতে দেন।
গুবরে পোকার শূককীট খুবই পুষ্টিকর খাবার। সেরিমিবিসাইডি গোত্রের বিভিন্ন প্রজাতির গুবরে পোকার মোটাসোটা শূককীট উপাদেয় খাদ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক-এর লোকেরা ওই লার্ভাকে কাঁচাই চিবিয়ে খায়। গ্রীস ও রোমের অতি সুসভ্য নাগরিকেরাও গুবরে পোকার শূককীট থেকে তৈরি খাবার , বেশ আনন্দের সাথেই খেয়ে থাকেন।
পেরুর জিভারো আদিবাসীর পাম উইভিল নামের গুবরে পোকাকে খুবই সুস্বাদু খাদ্য হিসাবে মনে করে। পশ্চিমভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের লোকেরা ইরগীটেস স্পিকুলাটাস বৈজ্ঞানিক নামের পোকাকে ধরে খান। পঙ্গপাল! নামের সঙ্গে কেমন একটা গা-ছম-ছম ভয় ভাব জড়িয়ে আছে। এরা ঝাঁক বেঁধে মেঘের মতো উড়ে এসে, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মাইলের পর মাইল শস্য ক্ষেত ধ্বংস করে। সে যাই হোক, বহু প্রজাতির পঙ্গপালই কিন্তু খাবারের প্লেটে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে আছে- (১) লেসার পরিযায়ী পঙ্গপাল যার বৈজ্ঞানিক নাম মেলানোপ্লাস অ্যাটলাসিস, (২) রক্তপদ পঙ্গপাল বৈজ্ঞানিক নাম মেলানোপ্লাস ফীমাররাব্রাম, (৩) দুইডোরা পঙ্গপাল বৈজ্ঞানিক নাম মেলানোপ্লাস বাইভিট্টাস।
কানাডার ডালভেগান, ভ্যাঙ্কুভার অঞ্চলের লোকেরা ঘাস ফড়িংকে বিলাসবহুল খাদ্য হিসাবে গণ্য করেন। তাঁরা ফড়িংগুলিকে প্রথমে আগুনে ঝলসে নেয়। তারপর তাকে গুঁড়ো করে নরম আঠালো লেই তৈরি করেন। এই লেই ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে রুটি তৈরি হয়। এ রুটি খেতে দারুণ উপাদেয়। শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীকেও রান্না করা ঘাস ফড়িং খেতে দেওয়া হয়েছিল। ঘাসফড়িংয়ের মধ্যে খাদ্য হিসাবে জনপ্রিয় হল- পেল্লুসিডা ও উপত্যকা ফড়িং এদের বৈজ্ঞানিক নাম এডালিওনোটাস এম্পিমা।
    ডাইটিসসিডি গোত্রের মিষ্টি জলের পোকার চাষ চিনে বেশ কয়েকযুগ আগেই শুরু হয়েছে। অনেকটা পুকুরে মাছ চাষের মতই ব্যাপার। এইসব পোকাকে জল থেকে তুলে রোদে শুকানো হয়। ঠিক গরম কেকের মতই তার বিক্রির বাজার। বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনের রেষ্টুরেন্টগুলিতে সম্ভ্রান্ত খাবার হল ‘গাউভ-গাইয়ান’, একপ্লেট এ খাবারের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৩৫ টাকা। খাবারটি তৈরি হয় রেশম মথের পুত্তলী থেকে।

 

আপনি যদি জুন-জুলাই মাসে আমেরিকার ওরিগণ ও ওয়াশংটন প্রদেশ যান, তবে হয়তো দেখতে পাবেন একদল লোক রাতের বেলায় মশাল জ্বালিয়ে পাইন বনের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এভাবেই তাঁরা সংগ্রহ করেন কালোরাডিয়া প্যান্ডেরা মথের শূককীট। এ থেকে তৈরি খাবার ‘পি-অ্যাগ-গাই’। ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয়। পতঙ্গ খাওয়ার ব্যাপারে ভারতীয়রা পিছিয়ে থাকলেও দক্ষিণ ভারতের নাল্লামালাই, কার্ডামম পার্বত্য অঞ্চলের লোকেরা উপপোকা খায়। তাছাড়াও উত্তরভারতের বহু আদিবাসী বিভিন্ন পতঙ্গ খেয়ে থাকে।
    আসুন না ! আমরাও ক্ষেত খামার থেকে পোকা ধরে খাই। প্রোটিন, স্নেহ ও শক্তিতে ভরপুর খাদ্য যখন হাতের কাছেই রয়েছে। তাছাড়া কীটনাশকের খরচও কমে যাবে। আর কোন পোকা খাদ্য হিসেবে কতটা উপকারী বা অপকারী, তা জানিয়ে দেবার জন্য জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ও সেন্ট্রাল ফুড রিসার্চ ল্যাবরেটারীর বিজ্ঞানীরা তো রয়েছেনই। চিন্তা কি?
    জানেন কি, তাঁরা জানাচ্ছেন প্রতি একশ গ্রামে, ঘাস ফড়িংয়ে আছে ৫৭ গ্রাম, গুবরে পোকায় রয়েছে ৬৪ গ্রাম, উইপোকায় আছে ৩৮ গ্রাম আর পঙ্গপালে রয়েছে ৬০ গ্রাম প্রোটিন? এছাড়া এই সব পোকামাকড়ের শরীরে স্নেহপদার্থ, শর্করা, লোহা, ক্যালসিয়াম, নিয়াসিন আর ভিটামিনের পরিমাণ জানলে আপনার চোখ কপালে উঠবেই।   

Join our mailing list Never miss an update