বজ্রপাত, পরিবেশ ও উপযোগিতা; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৪ সেপ্টেম্বর, সোমবার ১৯৯২; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত।
'বজ্রপাত' শব্দটির মধ্যে কেমন যেন ভয় ভয় ভাব লুকিয়ে আছে। ছোটবেলা থেকেই আমরা শুধু জেনে এসেছি বজ্রের ধ্বংসাত্মক কান্ডকারখানা। কিন্তু উদ্ভিদ তথা প্রাণীর অস্তিত্বরক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের পেছনে রয়েছে বজ্রপাতের বিরাট অবদান। বজ্রপাতের সেই উপযোগিতা নিয়েই এই নিবন্ধে আলোচনা করেছেন----
বাঙলার বর্ষা। মেঘে ঢাকা আকাশ, রিম ঝিম-ঝিম বৃষ্টি, মাঝে মাঝে গুরু গুরু গর্জনে বজ্রপাত। বর্ষার ছোঁয়াতেই প্রকৃতির মাঝে এসেছে প্রাণের জোয়ার। শীতে যে সব গাছপালা পাতাঝরা, রুক্ষ ছিল; বর্ষার সজল পরশে তারাই সবুজ কিশলয়ে সেজে উঠেছে।
না, উদ্ভিদ জগতের কাছে শুধুমাত্র বৃষ্টির জলই নয়; বজ্রপাতও সমানভাবে অপরিহার্য। হ্যাঁ, বিষয়টিতে অবাক হওয়ার কারণ আছে বৈকি! ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি বজ্রের ধ্বংসাত্বক কান্ডকারখানা। বাজ পড়ে বড়বড় গাছ ঝলসে যাওয়া বা বজ্রপাতের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের মনকে আতঙ্কিত করেছে। কিছু সমাজবিজ্ঞানী বলেন-‘ভয় থেকেই ভক্তির উৎপত্তি’। বিধ্বংসী বজ্রপাতের ভয়ের মধ্যেই বজ্রধর দেবরাজ ইন্দ্রের জন্মবীজ লুকিয়ে আছে কী না কে জানে?
বজ্রপাতের উপকারিতা বোঝার জন্য সবার আগে বাজ পড়ার কারণটি ভালোভাবে জানা যাক। এ কথা সবাই জানি যে, আমাদের এই মমতাময়ী মাটির পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে বাতাসের অদৃশ্য আবরণ, যাকে বলা হয় বায়ুমন্ডল। ভূপৃষ্ট থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত বায়ুস্তরের নাম ট্রোপোস্ফিয়ার। এর ওপরে রয়েছে ওজোন গ্যাসে পরিপূর্ণ স্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ার। ঝড়ঝঞ্জা-বৃষ্টি-তুষার-বজ্র এ সবের যা কিছু কারিগরি সবই কিন্তু ট্রোপোস্ফিয়ারেই সীমাবদ্ধ। বায়ুমন্ডলের এ স্তরে রয়েছে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস। এর মধ্যে আয়তন অনুপাতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ৭৭.১৬ শতাংশ, তারপর অক্সিজেন ২০.৬০ শতাংশ, জলীয় বাষ্প ১.৪০ শতাংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ০.০৪ শতাংশ, নিষ্ক্রিয় ও অন্যান্য গ্যাস ০.০৮ শতাংশ।
মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে ঘটে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান। এই আধানের পরিমাণ ১৫,০০০ ভোল্টের বেশী হলে তা এক মেঘ থেকে আর এক মেঘে সশব্দে ছড়িয়ে পড়ে বা মাটিতে নেমে আসে। এই ঘটনাই হল বজ্রপাত। আবহাওয়াবিদেরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, আমাদের এই সুবিশাল বায়ুমন্ডলে গড়ে প্রতি ঘন্টায় প্রায় তিন হাজারবার বজ্রপাত হচ্ছে। এই সময়ে তড়িৎ আধান ও উওাপের ফলে বায়ুর সংযুক্তির বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। স্কুলের পাঠ্য পদার্থবিজ্ঞানের বইতে গ্যাসের মধ্য দিয়ে তড়িৎমোক্ষণের যে বিষয়টি রয়েছে, সেটাই আর কি।
বজ্রপাতের সময় নাইট্রোজেন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে নাইট্রোজেনের অক্সাইড। এই অক্সাইড জলের সংস্পর্শে পরিণত হয় অতি লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডে। বিভিন্ন স্থানের বৃষ্টিতে অ্যাসিডের মাত্রা বিভিন্ন। সাবেক মধ্য রাশিয়াতে প্রতিবছর প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২.৫ টন অতিলঘু নাইট্রিক অ্যাসিড বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে নেমে আসে। এই পরিমাণ ভারত ও চীন ৩.৫ টন, হ্যানয় অঞ্চলে ৭ টন।
নাইট্রিক অ্যাসিড সহজেই মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। মাটির বিভিন্ন খনিজ পদার্থ সহজেই অ্যাসিডে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অ্যাসিড ও ধাতব অক্সাইডের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় নাইট্রেট লবণ; যা উদ্ভিদের অন্যতম পুষ্টি পদার্থ। মজার ব্যাপার হল বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ৭৭.১৬ শতাংশ হলেও, লিথোস্ফিয়ার বা মাটিতে এর পরিমাণ মাত্র ০.১ শতাংশ। প্রোটিন বা অ্যামিনো অ্যাসিডের অপরিহার্য উপাদান নাইট্রোজেন। বায়ুমন্ডলে বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন থাকলেও প্রাণী ও উদ্ভিদ তা গ্রহণে সম্পূর্ণঅক্ষম। অ্যাজোটোব্যাকটর নামের ব্যাকটিরিয়া মটর, ছোলা, প্রভৃতি লিগুমিনাস জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে থেকে বাতাসের নাইট্রোজেনকে যৌগে পরিণত করে। তবে তার পরিমাণ খুবই সামান্য। এর পাশপাশি আবার রয়েছে ডি-নাইট্রোফাইং ব্যাকটিরিয়া, যারা মাটির নাইট্রেট লবণ থেকে নাইট্রোজেন গ্যাসকে মুক্ত করে। অর্থাৎ মাটিতে নাইট্রোজেন বা পরোক্ষভাবে প্রোটিনের উৎস হল বজ্রপাত ও বৃষ্টির দ্বারা তৈরি নাইট্রিক অ্যাসিড।
নাইট্রোজেন আত্তীকরণ (Assimilation) রেখা চিত্র:
বায়ুর নাইট্রোজেন + অক্সিজেন বজ্রপাত নাইট্রোজেনডাই অক্সাইড বৃষ্টির জল নাইট্রিক অ্যাসিড, মাটির ধাতব অক্সাইড দ্রাব্য নাইট্রেট উদ্ভিদ দেহে উদ্ভিজ্জ প্রোট্রিন, প্রাণী দেহে প্রাণীজ প্রোটিন শিল্পাঞ্চলের বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড প্রভৃতি আরও বহুপ্রকার গ্যাস থাকে। এইসব গ্যাসের উপস্থিতি বায়ুদূষণ ঘটায়। বায়ুমন্ডলে বজ্রপাত বা বিদ্যুৎ ক্ষরণের ফলে গ্যাসগুলি অতিলঘু অ্যাসিডে পরিবর্তিত হয়ে মাটিতে নেমে আসে। তাই শুধু উদ্ভিদ ও প্রাণীর পুষ্টির জন্যই নয়, দূষণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরির পেছনেও বজ্রপাতের ভূমিকা অনেক বেশি। ‘সাইবেরিয়ান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব জিওলজির’ সহ –অধিকর্তা ভি বেগাটভ (V. Bgatov) একটি সুন্দর কথা বলেছেন- "যদি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বজ্রপাতের ঘটনা না হত, তবে বিশ্বের সকল কারখানাকে নাইট্রোজেন সারকারখানায় পরিণত করতে হত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ধরার বুকে থাকতো না কোন প্রাণস্পন্দন, কারণ প্রথম প্রোটোপ্লাজম সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে বজ্রপাতের অবদান।"