বার্ধক্যে স্নায়ুরোগ-স্ট্রোক; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৬; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বিভিন্ন স্নায়ুরোগের কারণে প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত হতেপারে। প্যারালাইসিস-ই শয্যাশায়ী হওয়া এবং চলাচলে অক্ষমতার অন্যতম প্রধান কারণ। প্যারালাইসিস অনেক কারণে হতে পারে এবং যে কোন বয়সে হতে পারে। বার্ধক্যে প্যারালাইসিস হওয়া বা শয্যাশায়ী হওয়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ হল ব্রেন স্ট্রোক। স্ট্রোকের অনেক কারণ রয়েছে, অনেক রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে, চিকিৎসাও রয়েছে। স্ট্রোক হওয়ার পরপরই যদি স্ট্রোকের পুনর্বাসন চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে শয্যাশায়ী থাকার নানারকম জটিলতা থেকে বৃদ্ধদের রক্ষা করা যায়।
স্ট্রোক কী? স্ট্রোক একটি অতি পরিচিত শব্দ। আমাদের সমাজে স্ট্রোক নামক রোগের নাম রোগের নাম শোনেননি এমন লোক খুব কম আছেন। স্ট্রোক সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত তা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নয়। অনেকেই মনে করেন স্ট্রোক মানে হার্ট অ্যাটাক। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগিকে হৃদরোগ-চিকিৎসার হাসপাতাল নিয়ে যান বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেন। আসলে স্ট্রোক হচ্ছে ব্রেন অ্যাটক বা ব্রেনের অসুখ। ব্রেন বা মগজের ভেতর রক্ত চলাচলের জন্য যেসব রক্তনালি থাকে সেসব থেকে স্ট্রোক নামক রোগের উৎপত্তি। অনেকে একে সেরিব্রো ভাস্কুলার অ্যাকসিডেন্ট বা সিভিএ বলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্ট্রোক হচ্ছে হঠাৎ বিনা আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কে প্রবাহিত ধমনিতে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়া বা রক্তক্ষরণ হওয়ার এবং যা থেকে উদ্ভুত স্নায়বিক উপসর্গাবলি যা ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয় অথবা রোগী ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যান। মগজের ভেতর প্রবাহিত এক বা একাধিক শাখায় রক্ত বন্ধ হতে পারে। ওই ধমনি বা শাখা ধমনিতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে অথবা অন্য কোনো ধমনি থেকে জমাট বাঁধা রক্ত বা অ্যামবলি ওইসব ধমনিতে আটকে গেলে। আবার ধমনি বা শাখা ধমনি সাধারণত উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে ছিঁড়ে গেলে বা ফেটে গেলে অর্থাৎ রক্তক্ষরণ হলেও মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, স্নানুকোষগুলি নষ্ট হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রকম স্নায়বিক উপসর্গ দেখা যায়। দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী রোগীর রক্ত জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোক হয়ে থাকে যাকে ইনফারকশন বলা হয়। এসব রোগীর তাৎক্ষণিক মৃত্যু হওয়ার আশংকা কম থাকলেও এঁদের বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুর বরণ করে থাকেন। অপরদিক মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের রোগীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর আশংকা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুত্বের হার এঁদের মধ্যে কম হয়।
স্ট্রোক কাদের বেশি হয :
সাধারণত বয়ষ্ক পুরুষদেরই স্ট্রোক বেশি হয়ে থাকে। ৪০ বছরের কম বয়সিদের স্ট্রোক কম হয়ে থাকে। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সিদের সাধারণত উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে স্ট্রোক হয়ে থাকে। অবশ্য উচ্চ রক্ত চাপ দ্রুত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার ফলে এই বয়সিদের মধ্যে স্ট্রোকের হার কমে আসছে। তবে বয়ষ্ক জনসংখ্যার ভেতর পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসাবে গণ্য করা হয় স্ট্রোককে। সার্বিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় স্ট্রোক হওয়া রোগীদের ২৫ ভাগ মৃত্যুবরণ করেন। ২৫ ভাগ প্রায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যান। ২৫ ভাগ আংশিক পঙ্গুত্ব নিয়ে অনেকটা স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারেন। বাকি ২৫ ভাগ স্থায়ী পঙ্গুত্ব নিয়ে পরনির্ভর জীবনযাপন করে থাকেন।
স্ট্রোক কেন হয় ? স্ট্রোকের সঠিক বা নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই এটি মস্তিষ্কের রক্তনালির অসুখ। তবে এর বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান রয়েছে। যেগুলির প্রভাবে ওই রক্তনালিগুলি সহজেই আক্রান্ত হয়। ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানগুলির বেশিরভাগকেই শনাক্ত করা সম্ভব এবং এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রাথমিক কারণগুলি থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানগুলি কমানোর জন্য প্রাথমিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মদ্যপান, অলস জীবনযাপন বা কম শারীরিক কাজ করা এবং নিয়ম না মেনে চলা (সেডেন্টারি লাইফ স্টাইল), ডায়াবেটিস, মেদবহুল শরীর, রক্তে বিদ্যমান চর্বি, জন্মবিরতিকরণ পিল বা দীর্ঘদিন ইস্ট্রোজেন জাতীয় হরমোন গ্রহণ, পারিবারিক ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থা এসব। কিছু রক্তরোগ যেমন পলিসাইথেমিয়া-তে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কের ধমনিতে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হতে পারে। হৃদপিন্ড বা রক্তনালির আরও কিছু অসুখে রক্ত জমাট বেঁধে অ্যামবলি-র উৎপত্তি হতে পারে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হৃদপিন্ডের ভালভের অসুখ, হার্টের ইনফেকশন, হার্ট অ্যাটাক। রক্তনালির কিছু অসুখের জন্য স্ট্রোকের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রক্তনালিতে চর্বি জমে রক্তনালি সরু হয়ে যাওয়া ও বিভিন্ন বাত রোগের জেরে রক্তনালিতে প্রদাহ।
স্ট্রোকের প্রকারভেদ :
স্ট্রোকের বিভিন্নভাবে শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে। প্রধান দুইটি ভাগ হল ইনফারকশন এবং হেমোরেজ বা রক্তক্ষরণজনিত। উপসর্গ অনুযায়ী কয়েকভাগে ভাগ করা যায়, যেমন কমপ্লিটেড স্ট্রোকে স্নায়বিক উপসর্গগুলি সাধারণত ৬ ঘন্টার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছায়। স্ট্রোক ইন ইভুলিশনে স্নায়বিক অবনতি ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মাইনর স্ট্রোকের রোগী ৭ দিনের মধ্যে স্নায়বিক দুর্বলতা কাটিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। ট্রিনজিয়েন্ট ইসকিমিক অ্যাটাক বা টি আই এ ঠিক স্ট্রোকের আওতাভুক্ত নয়। এখানেও একই নিয়মে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে স্নায়বিক উপসর্গ দেখা দেয় তবে তা ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয় না। টি আই এ-কে স্ট্রোকের ক্ষেত্রে একটি বড় রিস্ক ফ্যাক্টর বলে ধরা হয়।
প্রাথমিক প্রতিরোধের উপায় : স্ট্রোকের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান বা রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি থেকে প্রাথমিক প্রতিরোধ খুব কঠিন কিছু নয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপের যথাযথ চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা বা কমিয়ে দেওয়া, নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা ও হাঁটা, অলস কর্মহীন জীবনযাপন পরিত্যাগ করা, মেদবহুলতা কমানো বা ওজন কমানো, চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা, সবজি ফলমূল বেশি খাওয়া, দুশ্চিন্তা ও হতাশমুক্ত থাকার চেষ্টা করা, অতিরিক্ত ঝুঁকি বহনকারী রোগীর নিয়মিত স্বল্পমাত্রায় অ্যাসপিরিন খাওয়া, মহিলাদের ভেতর যাদের নিকটাত্মীয় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন বা যাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের জন্মবিরতিকরণ পিল বা ইস্ট্রোজেন জাতীয় ওষুধ না খাওয়া, রক্তে অতি মাত্রায় চর্বি থাকলে তার যথাযথ চিকিৎসা করা।