তাঁর চোখ আলো ছড়াবে. . .

তাঁর চোখ আলো ছড়াবে. . .

ছোট্টবেলায় তিনি কিচ্ছু হতে চাইতেন না। শুধু সবসময় খেলতে চাইতেন। তার সাথে ছিল রকমারী দুষ্টমি। আট-নয় ক্লাস থেকেই প্রেম হয়ে যায় শিল্প-সাহিত্যের সাথে। সেই শুরুয়াৎ। তারপর বহু পাকদন্ডি-সরণী ধরে চলচ্চিত্রের রাজপথে। সিনেমাজগতের ব্যতিক্রমী অভিনেতা শুভেন্দু চাট্টোপাধ্যায়।

জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৯ শে নভেম্বর¯। বাবা শৈলেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মা মণিমালা দেবী। স্কুল জীবন কেটেছে হাওড়ার বালিতে। প্রথমে পাড়ায় নাটকে অভিনয়, গান-বাজনা, ডিবেট আরো কত কী। সেসময়ে তাঁর গল্প-কবিতা ছাপা হয়েছে কিছু অনামী পত্র-পত্রিকায়। পেশাদার নাটক দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা ১৯৩৭ সালে। নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির ‘মাইকেল মধূসূদন’ পালা। এই নাটকই উল্টেপাল্টে দিল তাঁর জীবনের গ্রামার। মাথায় চিরতরে ঢুকে গেল অভিনয়ের পোকা। অভিনয় দেখাটা যদি এমন আনন্দের হয়; তবে অভিনয় করাটা কতই না মজাদার হবে! ১৯৫৩ সালে স্কুল ফাইনাল পাস করেন। ঠাকুর্দা ছিলেন ইংরেজ জামানার সিভিল সার্জেন। হ্যাট-কোট পরা বেশ সম্মানীয় ব্যাপার। বাবার ইচ্ছে ছিল যে তার কোন এক ছেলে ডাক্তার হোক। ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৫০ সালে এম.বি.বি.এস পাস করলেন। ১৯৫৮-৫৯ সালেই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন পুরোদমে অভিনয় করবেন।  
    ডাক্তারী পাশের পর আই.পি.টি.এ-তে যোগ দেন। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উৎসবে ‘নৌকাডুবি’-তে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।এ সূত্রেই পরিচয় হয়ে গেল মৃণালবাবুর সাথে। মৃনাল সেন একদিন বললেন-‘‘একটা ছবি করছি ‘আকাশ কুসুম’ । নায়কের বন্ধুর একটা রোল আছে, তোমাকে মানিয়ে যাবে’’। সিনেমা প্রেমীদের আজও মনে পড়ে আকাশ কুসুমের সেই বন্ধুটির কথা। নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যার কাছ থেকে জামা-প্যান্ট ধার করে নিয়ে যেত; নায়িকাকে ইমপ্রেস করতে। ‘আকাশ কুসুম’ মুক্তির পর শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে আর বাড়তি পরিচয় দেবার দরকার হয় নি। তখন তিনি চাকরী করছেন। প্রথমে সিভিক ডিফেন্স ও পরে কলকাতা পুরসভার মেডিকেল অফিসার পদে। দেখলেন মেডিকেল অফিসারী আর অভিনয় একসাথে করা যাবে না। চাকরীটা ছেড়ে দিলেন। বাবাকে বললেন- ‘‘তোমার ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হোক; হয়েছে, এবার জীবনটা আমার, সেটা আমার মতো করে কাটাবো।’’ তারপর একের পর এক ছবিতে অফার আসতে লাগলো। নায়কের রোল পেলেন ‘শীলা’ ছবিতে। তারপর ‘হংস মিথুন’। পাশাপাশি চলছে মঞ্চ অভিনয়। শ্যামবাজারী পেশাদারী  নাটকে নিয়মিত অভিনেতা। তাঁর নির্দেশনা ও অভিনয়ে ‘অমর কণ্টক’ এক জনপ্রিয় পালা। তেমনভাবে শিশির ভাদুড়ির ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। দু’ একবার প্রণাম টণাম করার সূযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু একলব্যের  মতো তাকেই দ্রোণাচার্যের স্থান দিয়েছিলেন। শুভেন্দুদার ড্রয়িং রুমে রাখা নাট্যাচার্যের ছবিটি সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।
    সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর প্রথম আলাপ তেমন কাজের হয়নি। সত্যজিৎবাবু তাঁর নতুন ছবির জন্য শিল্পী খুঁজছিলেন। রবি ঘোষ সে কথা শুভেন্দুদাকে বলেন। শুভেন্দুদা একদিন গেলেন সত্যজিৎবাবুর কাছে। কিন্তু কিছুকথা হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন-‘‘যে রোলের জন্য শিল্পী খুঁজছি সেখানে তোমাকে ঠিক মানাবে না’’। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় সে সময়ের জন্য হতাশ হয়েছিলেন। আবার ‘চিড়িয়াখানা’র সময় নিজে থেকেই শুভেন্দুবাবুকে ডেকে পাঠান। তারপর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ থেকে ‘গণশত্রু’ তো সবটাই ইতিহাস। প্রায় চল্লিশটি ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায় সদর্পে অভিনয় করেছেন। তারপর চরিত্রাভিনেতা-সেটাও দীর্ঘ পথের যাত্রা। স্বকন্ঠে গান করেছেন সুখেন দাসের ‘রাজনন্দিনী’ ছবিতে।
তাঁর ফ্লিমি ইমেজটা আমার বইয়ের প্রচারে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। একে তো কোন আদ্দিকালে পাশ করেছেন; তার ওপর সেভাবে ডাক্তারী করেন না। এইসব কার্ডিওলজির ডাক্তারী ব্যাপার স্যাপার কী আর বুঝবেন। পান্ডুলিপিটি তাঁর হাতে দেওয়ার পর আমার সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে নিজের কাছে নিজেই বহুবার ক্ষমা চেয়েছি। আমার লেখা হৃদরোগ সংক্রান্ত ‘হৃদয়ের কথা’ বইটি তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। বহু জায়গায় বিষয়গত ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। ‘ফ্যালটস টেট্রালজি’ হৃদবিজ্ঞান বা কার্ডিওলজির এক জটিল বিষয়। এ সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা আমি লিখেছিলামÑ তা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। শুভেন্দুদা তা সুন্দরভাবে সম্পাদনা করেন। স্থানাভাবে তার স¤পূর্ণ মন্তব্য আমার বইতে ছাপা যায় নি। পেশাগত ভাবে চিকিৎসক না হওয়া সত্তে¡ও চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ছিল আপ টু ডেট।
গম্ভীর ও মিশুকে এক অ™ভুত মেলবন্ধন ছিল শুভেন্দুদার মধ্যে। ঘটি বলেই বোধ হয় মিষ্টি খেতে বেশি ভালোবাসতেন; খাওয়াতেনও। বাড়িতে সবসময় সেন মহাশয়ের সন্দেশ থাকতো। প্রিয় চিংড়িমাছ, তবে শেষের দশ বছর তিনি নিরামিষই বেশি খেতেন।
গণনাট্য সংঘে যাওয়ার আগে থেকেই তাঁর একটি সমাজতান্ত্রিক, যুক্তিবাদী মন তৈরি হয়ে যায়। ধর্মের বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল খুব পরিষ্কার। মানবতাবাদ ছাড়া আর কোন ধর্মেই বিশ্বাস ছিল না। তিনি বেশ মজা করে কয়েকটি কথা বলতেনÑ‘‘হিন্দু, মুসলমান, পার্সি, খ্রীষ্টান ইত্যাদি যত আছে, সবাইতো ভগবানভিত্তিক। কোন ধর্মেই আমি বিশ্বাস করি না; তার কারণ ভগবানেই আমার বিশ্বাস নেই। এই কথাটার মধ্যে আবার একটা বিষয় নিহিত আছে; যেন ভগবান আছে, কিন্তু আমি তাতে বিশ্বাস করি না। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। ভগবান বলেই যে কিছু আছে, সেটাই আমি বিশ্বাস করি না। এটা একদম মানুষের ভুল। ভগবান বলেই যে কেউ নেই-এই ব্যাপারটায় আমি একেবারে নিঃসন্দেহ’’। তাঁর একই ধরনের বক্তব্য ছিল ‘ভাগ্য’ সম্বন্ধে-‘‘প্রত্যেকটি কাজ একটা চেন অফ রিয়্যাকশন’’। এই দেখো কুম্বলে বল করছে, বলটা বেঁকল, তলায় শ্যুট করল, গিয়ে উইকেটে লাগল। ব্যাটসম্যান বোল্ড হল। এটা ব্যাটসম্যানের দুর্ভাগ্য না অনিল কুম্বলের সৌভাগ্য? দুটোই কর্ম। বল ছোঁড়াটা একটা কর্ম, ব্যাটসম্যানের প্রতিরোধ করাটা আরেকটা কর্ম। ও সেটা পারল না, ক্রেডিটটা চলে গেল বোলারের কাছে। এখানে ভগবান আসছে কোথায়? অনেকেই সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত বলে এড়িয়ে যান। এটা জ্যোতিষীদের এস্কেপিজম’’।

চিকিৎসক হওয়ার পর অভিনয়ে এসে তিনি নাট্যশাস্ত্রকে ঋদ্ব করেছেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন-‘‘অ্যানটমিটা জানি বলেই একজন মানুষ রেগে গলে তার মুখের ম্যাসেটার ও টেপোর‌্যালিসি পেশি কোথায় কেমন হবে তা সহজেই বুঝতে পারি। কাউকে চেপে ধরতে গেলে হাতের ট্রাইসেস ব্রাকিয়াই ও ব্রাকিও ব্যাডিয়ালিস পেশীতে কতটা চাপ পড়বে তা জানি’’। সত্যজিৎ রায়ও কয়েক জায়গায় ডাঃ শুভেন্দু চ্যাটার্জির এই জ্ঞানের সাহায্য নিয়েছিলেন। পেশাগত ভাবে বেশিদিন ডাক্তারী করেননি। তবে কারা কারা তাঁর দেওয়া ওষুধ খেয়েছেন সেই তালিকাটা যে কোন ডাক্তারের কাছে ঈর্ষার বিষয়। ছবি বিশাস, সমরেশ বসু, পাহাড়ি স্যান্নাল, উত্তম কুমার, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, দীলিপ রায় আরো বহু স্বনামধন্য মানুষ।
আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তাঁর পড়াশোনার পরিধি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ই এম ফর্ন্টার, লুইজি পিরানদেল্লা থেকে শুরু করে আর্থার সি ক্লাক, ডেভিড ম্যালাফ, এডগার স্নো, অ্যান্টনি ম্যাসকারেনাস কী পড়েননি। প্রসঙ্গ উঠলেই বলতে পারতেন সব বিষয়ই। সিনেমাজগতের আর কোন অভিনেতার এতো বিস্তৃত পড়াশোনা আছে কী না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় বাইরেও তাঁর বন্ধু, কাছের মানুষের সংখ্যা অগুণতি। এটা সম্ভব হয়েছে তিনি সকলের সমব্যথী ছিলেন বলে। হয়তো চিকিৎসক হওয়ার কারণে তিনি অন্যের ব্যাথা-বেদনা সহজেই অনুভব করতে পারতেন। দৃঢ়চেতা, স্পষ্টবক্তা, পরিমিত রসরোধ, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক এই মানুষটি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ইচ্ছে ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে মরণোত্তর দেহদান করার। পারিবারিক সম্মতি না মেলায় তা পারেননি। তবে প্রয়াণের আগে তিনি তাঁর চোখদুটি আই ব্যাঙ্কে দান করে গেছেন। চিকিৎসকেরা তাঁর ইচ্ছা পুরণে গাফিলতি করেননি। তাই তাঁর দুটি চোখ আলো ছড়াবে আরো বহু দূরে।

Join our mailing list Never miss an update