ঘুড়ি : রণে ও বিজ্ঞানে

ঘুড়ি : রণে ও বিজ্ঞানে

ঘুড়ি : রণে ও বিজ্ঞানে; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২৭ ভাদ্র ১৪০৫ রবিবার ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮; আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ঘুড়ির প্রচলনের কাহিনী নিয়ে যা বলেন, তা হল- খ্রিষ্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে প্রথম ঘুড়ির প্রচলন হয় চীন দেশে। ৫০০ সালে পূর্বদিকের দেশগুলি জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে ও পশ্চিমদিকের আরবীয় দেশে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। ইউরোপে প্রথম ঘুড়ির প্রবেশ হয় ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে এক ডাচ বণিকের মাধ্যমে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুড়ি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
    আমাদের দেশে বাক্স ঘুড়ি, মাছ ঘুড়ি, পতঙ্গ ঘুড়ি, চৌকো ঘুড়ি প্রভৃতির প্রচলন আছে। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত চৌকো বা হীরের আকারে ঘুড়ি। এই ঘুড়িগুলি দ্বি-মাত্রিক; ওড়ার সময় মাথাটি সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। সুতোর টানের জন্য পিছন অপেক্ষা সামনের বাতাসে বেশি চাপ দেয়। এই চাপের ব্যবধানের জন্য যে রেসাল্টটেন্ট ফোর্স বা লদ্ধি বলের সৃষ্টি হয় সেটাই ঘুড়িকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে। সুতোর টান যত বাড়ানো হবে ঘুড়ি ততই তার সামনের বাতাসে চাপ দেবে, ফলে ঘুড়ি ওপরে উঠবে। এ কারণেই লাটাইতে সুতো গোটালে ঘুড়ি উঁচুতে উঠতে থাকে।
    দূর আকাশের ঘুড়ি শুধু মানুষের কল্পনাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় না। এর সদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
    এক ঝাঁক উড়ন্ত ঘুড়িকে দেখে কামান্ডার নির্দেশ দিলেন, ‘ফায়ার’! সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল বিমান ধ্বংসী কামানগুলি। না-না এ কোন রণাঙ্গনের বর্ণনা নয়। যুদ্ধের মহড়া মাত্র। এসবেই মার্কিন নৌবাহিনীর গোলন্দাজদের নিশানা অনুশীলন করার জন্য, কমান্ডার পল গার্বার ঘুড়িকে লক্ষ্য বস্তু হিসাবে ব্যবহারের প্রচলন করেন। কিন্তু এর বহু আগেই ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সামরিক কাজে ঘুরির ব্যবহার শুরু হয়েছিল।
    তখনও বিমান আবিষ্কৃত হয়নি। সেনাদের প্রকান্ড ঘুরিতে বেধে ওপরে ওঠানো হতো যাতে বহু দূরে থাকা শত্রুদের শিবিরে নজরে আসে। মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন বা ডেন্ পাওয়েল ১৮৯১ সালে এক সৈনিককে ঘুড়িতে বেঁধে ১২০ ফুট উঁচুতে তুলেছিলেন।
    পাখি বা ঘুড়ি উড়ন্ত বিমানের কাছে কামানের গোলার মতোই মারাত্মক। এ আমাদের অজানা নয় তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর রণতরীগুলির সাথে অসংখ্য ঘুরি বাধা থাকত, যাতে শত্রুপক্ষের বিমান পিছন থেকে আঘাত হানতে না পারে। বিগত বিশ্বযুদ্ধে ঘুড়ির সাথে ধাক্কা লেগে চারটি জার্মান বিমান নষ্ট হয়েছিল। এইসব ঘুড়ির নক্সা তৈরি করেছিলেন হ্যারি.সি.সার্ডলস।

    ঘুড়ি রণক্ষেত্রকে যেমনভাবে ফলপ্রসু করেছে; ঠিক তেমনি বিজ্ঞান-জগৎকেও। সে কাহিনী বেশ রোমাঞ্চকর।
    আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। প্রকান্ড এক ঘুড়ি নিয়ে পিতাপুত্র ছুটলেন মাঠের দিকে। ঘুড়িটি উড়িয়ে দিলেন দূর আকাশে। কিছুক্ষণ বাদেই শোনা গেল গুরু গুরু স্বরে মেঘের গর্জন। শুরু হল বৃষ্টি ও বিদ্যুতের চমক। ঘুড়ির রেশমী সুতোয় বাঁধা তামার চাবিটিতে হাত দিতেই মাটিতে ছিটকে পড়ল বুড়ো পন্ডিত। বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-এর এই পরীক্ষার কথা আমাদের অজানা নয়। ১৭৫২ সালে এভাবেই বেঞ্জামিন বুঝতে পেরেছিলেন, প্রাকৃতিক বিদ্যুতের সঙ্গে ঘরের বিদ্যুতের কোনও গঠনগত তফাৎ নেই।
    এ ঘটনা ঘটার তিন বছর আগেই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঘুড়ির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। স্কটল্যান্ডের দুই বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার উইলসন ও টমাস মেলভিল ১৭৪৯ সালে ঘুড়ির সঙ্গে ম্যাক্স-মিন থার্মোমিটার বেঁধে আকাশে ওড়ান। তাঁরা বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরের তাপমাত্রা পরিমাপের চেষ্টা করেন। টেলিফোন যন্ত্রের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলও ১৯০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাউস এক বাক্স ঘুড়িতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি লাগিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
    এরোপ্লেন আবিস্কারের পিছনে ও ঘুড়ির ভূমিকা কম নয়। অস্ট্রেলিয়ান সাহেব হার গ্রাভস ১৮০৯ সালে ত্রি-মাত্রিক বাক্সঘুড়ি তৈরির পর থেকেই বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন। রাইটভাইদের আবিস্কৃত এরোপ্লেনের মডেলের সঙ্গে বাক্সঘুড়ির খুবই মিল আছে। ১৮৯৩ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মার্কিনি আবহাওয়া সংস্থান (যেটি এখন ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস নামে পরিচিত) আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেতে ঘুড়ির সাহায্য নিত।
    ঘুড়িকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে প্রযুক্তিবিদরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। ১৮৪৭ সালে কানাডা ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে নায়াগ্রা নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতুটি তৈরি করার সময় দড়ির মইকে নদীর এপার থেকে ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঘুড়ির সাহায্যে।
    গুহা মানবের খোল থেকে বেরিয়ে মানুষের নিত্য নতুন আবিস্কার-গবেষণা এভাবেই মানুষকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বেতার যন্ত্রের এরিয়াল এর উচ্চতা বেতার সংকেতের সম্প্রসারণ-ক্ষমতা বাড়ায়, তাই বিংশ শতাব্দের প্রথম দিকে বেতার যন্ত্রের এরিয়ালকে বাক্স ঘুড়ির মাধ্যমে উঁচুতে তুলে যুদ্ধক্ষেত্রের খবর আদান-প্রদানও করা হয়। মনের আনন্দকে আকাশে উড়িয়ে দেয় যে ঘুড়ি তারই ভূমিকা আবার যুদ্ধক্ষেত্র- বিজ্ঞান- প্রযুক্তিতে।

  

Join our mailing list Never miss an update