আঁধার রাত অন্ধকার কেন? ডাঃ পার্থপ্রতিম; শারদীয়া সংখ্যা ১৪০৯ উত্তরের হাওয়া পত্রিকায় প্রকাশিত
আঁধার রাত অন্ধকার কেন? প্রশ্নটি সত্যই উদ্ভট। শুনে কেউ হাসবেন, কেউ হয়তো প্রশ্নকর্তাকে পাগল ভাববেন, কারো কাছে জিজ্ঞাসাটি শিশুসুলভ মনে হতে পারে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এমনই প্রশ্নতুলে বিজ্ঞানীমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল হ্যালি ধূমকেতুর আবিষ্কারক স্যার এডমন্ড হ্যালি।
বিষয়টিকে আরো সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করলেন জ্যোতির্বিদ হাইনরিক ওলবার্স। অমাবস্যা রাতের আকাশে সূর্য-চাঁদ নেই বটে; কিন্তু সূর্যের মতো ও তার চেয়েও উজ্জ্বল অসংখ্য নক্ষত্র আকাশের প্রতিটি জায়গা জুড়ে রয়েছে। অসীম-অনন্ত বিশ্বের অগুণতি নক্ষত্র, নক্ষত্রজগত, নীহারিকা প্রভৃতি উজ্জ্বল বস্তুরা যে যার জায়গায় থাকলে; যে দিকে তাকানো যাবে সে দিকেই চোখ পড়বে কোন না কোন আলোর রোশনাই, যেন আকাশটাই ছিদ্রহীন আলোর চাদর দিয়ে ঢাকা। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন-তারা- নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য তাদের দূরত্বের উপর নির্ভর করে না। ঔজ্জ্বল্যের দিক থেকে সূর্য একটি সাধারণ নক্ষত্র মাত্র। সুতরাং নক্ষত্রগুলির মিলিত আলোয় সমস্ত আকাশ দিন ও রাতে সমানভাবে উদ্ভাসিত থাকবে- এটা হওয়াই তো স্বাভাবিক?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রায় দু’শো বছর কেটে গেল। ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল বললেন- অনন্ত বিশ্বে তারা -নক্ষত্ররা যদি যে যার জায়গায় স্থির হয়ে থাকতো তবে হয়তো দিন রাতের ভেদাভেদ সত্যই থাকতো না। নক্ষত্র, নক্ষত্রজগত, এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোন কিছুই নিশ্চল নয়, যে যার থেকে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। এখানে আরো মজার ব্যাপার হলো-নক্ষত্র বা নক্ষত্রজগত একে অপরের থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে, এই অপসরণ বেগও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন করে বহু দূরবর্তী নক্ষত্রজগতের বেগ প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ডপলারের নিয়ম অনুসারে তাদের আলোর রঙ বদলে যাচ্ছে। এই ভাবে পাল্টে যেতে যেতে আলোর বর্ণ এমন হয়ে পড়ছে যা আমাদের চোখে অনুভূতি জাগায় না।
ডপলারের প্রভাব শব্দবিজ্ঞানে একটি সুপরিচিত ঘটনা। বিষয়টিকে বুঝতে উদাহরনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, সরাইঘাট এক্সপ্রেস হুইসিল দিতে দিতে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। দূর থেকে ট্রেনটি যখন স্টেশনের দিকে আসছে, তখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা নিতাইবাবুর কানে হুইসিলের শব্দ তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্মতর মনে হবে। আবার ট্রেনটি যখন স্টেশন থেকে দূরে যাচ্ছে, তখন তার তীক্ষ্মতা ক্রমশঃ কমে যাবে। অর্থাৎ যখন শ্রোতা ও শব্দের উৎসের মধ্যে আপেক্ষিক গতি থাকে তখন শ্রোতার কানে আসা শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে আসে। আর উৎস যখন শ্রোতার থেকে দূরে সরে যায় তখন শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে আসে। আর উৎস যখন শ্রোতার থেকে দূরে সরে যায় তখন শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রকৃত তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকে বেড়ে যায়। ১৮৪২ সালে অস্ট্রিয়ার গনিতবিদ ক্রিস্টিয়ান জেমস ডপলার এই বিষয়টিকে প্রথম লক্ষ্য করেন, তাই একে ডপলার প্রভাব বলা হয়। ডপলার প্রভাব শুধু শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রেই নয়, আলোক তরঙ্গের বেলাতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য।
দৃশ্যমান বর্ণালী অর্থাৎ যে সব রঙের আলো আমাদের চোখে ধরা পড়ে, তারমধ্যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে ছোট হলো বেগুনী আলোর ০.৪ মাইক্রন। আর সবচেয়ে বড় হলো লাল আলোর ০.৭ মাইক্রন (১ মাইক্রন = ১ মিটারের ১ কোটি ভাগের ১ ভাগ)।
আলোর বিভিন্ন বর্ণগুলি হলো :-
অতিবেগুনী (অদৃশ্য) -০.১০ -০.৪০ মাইক্রন
বেগুনী -০.৪০ -০.৪২ মাইক্রন
নীল -০.৪২ -০.৪৯ মাইক্রন
সবুজ -০.৪৯ -০.৫৭ মাইক্রন
হলুদ -০.৫৭ -০.৫৮ মাইক্রন
কমলা -০.৫৮ -০.৬৪ মাইক্রন
লাল -০.৬৪ -০.৭০ মাইক্রন
অবলোহিত (অদৃশ্য) -০.৭০ -১.০০ মাইক্রন
আলোর ওপর ডপলার প্রভাব থাকার ফলে, বেগুনী আলোর কোন উৎস বা বাতিকে ক্রমবর্ধমান বেগে দূরে নিয়ে যেতে থাকলে তার রঙ পরপর বদলে গিয়ে নীল-সবুজ-কমলা-লাল ও শেষে অদৃশ্য অবলোহিত হয়ে যাবে।
মহাকাশের নক্ষত্র বা নক্ষত্রজগত আমাদের থেকে প্রচন্ড গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই সেখান থেকে আসা আলোকরশ্নির বেশীর ভাগই অবলোহিত রশ্নিতে পরিণত হয়ে যায়।
১৪০০ সালে উইলিয়াম হার্শেল সবার প্রথম অবলোহিত বা ইনফ্রারেড রশ্নির অস্তিত্ব লক্ষ্য করেন। কিন্তু বিশিষ্ট মার্কিন বিজ্ঞনী অধ্যাপক ল্যাংলে-এর উপর বিস্তারিত পরীক্ষা চালান। দৃশ্যমাণ আলোর সাপেক্ষে কাচ স্বচ্ছ, কিন্তু অবলোহিত তরঙ্গ কাচের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। রকসল্ট, কোয়ার্টজ, সিলভাইন প্রভৃতি বস্তুর তৈরী প্রিজমে এই বর্নালী পরীক্ষা করা যায়। রাতের অন্ধকারে ইনফ্রারেড রশ্নির সাহায্যে ছবি তোলা যায়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে তৈরী ফটোগ্রাফী ক্যামেরা ও ফ্লিম ব্যবহার করা হয়।
এই বসুন্ধরা অবলোহিত রশ্নিতে দিন ও রাতে সমান ভাবে উদ্ভাসিত থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অবলোহিত রশ্নি আমাদের চোখে অনুভূতি জাগায় না। বিশ্বে এতো আলো থেকেও আমাদের কাছে তা নেই। অমাবস্যার আঁধার রাত এ কারণেই অন্ধকারে ঘেরা।