জুতো নিয়ে স্বাস্থ্যভাবনা; ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ বুধবার; পৃষ্ঠা-এগারো; ওভারল্যান্ড পত্রিকায় প্রকাশিত
পূজার কেনাকাটার তালিকায় জামা-কাপড়ের পরেই জুতোর স্থান। জুতো পছন্দের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় রঙ ও আধুনিক ফ্যাশনই গুরুত্ব পায়। কিন্তু জুতোটি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা হয়তো আমরা একবারও ভেবে দেখি না। জুতো স্বাস্থ্যসম্মত না হলে দেখা দেয় নানা শারীরিক উপসর্গ।
একথা আমরা সবাই জানি যে, জুতো বা চটির মাধ্যমে দেহের সমস্ত ভার মাটিতে সঠিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। হবু রাজা যতই বলুক- 'মলিন ধুলো লাগিবে কেন পা-য় ধরনী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র..' আসলে পায়ের পাতাকে ঢেকে রেখে সুরক্ষা ও স্বচ্ছন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই জুতোর ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের পায়ের পাতায় রয়েছে ২৬টি হাড়, পঁয়ত্রিশটি অস্থিসন্ধি বা জয়েন্ট ও প্রায় একশোটি লিগামেন্ট। দেহের ভার টিবিয়া ও ফিবিউলা নামের হাড় দু’টির মাধ্যমে পায়ের পাতায় নেমে আসে। পায়ের গোড়ালিতে ৭টি টারসাল অস্থি টিবিয়া ও ফিবিউলার সঙ্গে যুক্ত থাকে। আবার ৫টি মেটাটারসাল হাড় লেগে থাকে টারসালের সঙ্গে। ৭টি টারসালের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা অস্থিটির নাম ক্যালকেনিয়াম (Calcanium)। এর ওপরে অবস্থিত ট্যালস (Talus) নামের হাড়টি পরোক্ষভাবে দেহের অর্ধেকভার বহন করে। পায়ের পাঁচটি আঙুলে রয়েছে মোট ১৪টি ছোট ছোট ফ্যালেঞ্জেস অস্থি। আমাদের পায়ের পাতা দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের মতো কাজ করে, ফলে হাঁটা-চলার সময় আমরা কিছুটা যান্ত্রিক সুবিধে পাই।
সূঁচলো মাথার জুতো পরলে বুড়ো আঙুল ও পায়ের পাতার সংযোগস্থলের হাড় বা মেটাটারসালবোন উঁচু হয়ে ওঠে, এর সঙ্গে অনেক সময় ব্যথা-বেদনা শুরু হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় বানিয়্যান (Bunion)। উপসর্গ বেশি হলে অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় থাকে না। এছাড়াও সূঁচলো জুতোয় দু’টি আঙুলের মাঝে যথেষ্ট ফাঁক বজায় না থাকার জন্য, ঘামে ভিজে সেখানকার চামড়া সাদা হয়ে যায়। পরে এর থেকে চুলকানি ও ঘা হয়ে থাকে। গোলমুখ বা প্রায় হাঁসের ঠোঁটের মতো জুতো পরা ভালো। খুব আঁটসাঁট জুতো পরলে অনেক সময় ত্বকের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে কিছু কোষ মৃতকোষে পরিণত হয়ে কড়া বা কর্ণ (Corn) পড়ে। এক জুতো তৈরি সংস্থার সমীক্ষায় জানা গেছে- যাঁরা জুতো ব্যবহার করেন তাঁদের পা গড়ে দিনে ৪৫০০ বার ওঠানামা করে।
শিশুদের পা স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত বড় হতে থাকে। তাই তিনবছর বয়স না হলে জুতো না পরানোই উচিত। সম্ভব হলে এদের খালি পায়ে পরিষ্কার মাঠে হাঁটাচলা করতে দিন। বাচ্চাদের যদি জুতো পরাতেই হয়, তবে শক্ত চামড়া বা প্লাস্টিকের জুতো না পরিয়ে কাপড়ের কেডস ব্যবহার করা ভাল। জুতো ছোট হলেই সেটি বদলাতে হবে, না হলে পায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ব্যক্তি বিশেষে হাঁটা-চলার ভঙ্গি বিভিন্ন। সে কারণেই কোনও ব্যক্তি যখন নতুন জুতো বেশ কিছুদিন ব্যবহার করেন, তখন জুতোটি তার পায়ের গড়ন ও হাঁটার ভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রসারিত বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তাই কারও ব্যবহৃত পুরনো জুতো আর একজনের পরা উচিত নয়।
জুতো সবসময়েই আরামদায়ক এবং সঠিক মাপের হওয়া দরকার, যাতে পা মাটির সঙ্গে সামান্য তির্যক অবস্থায় থাকে অর্থাৎ গোড়ালির দিকটা সামান্য উঁচু হবে। তবে এই তির্যক কোণের মান কোনও অবস্থাতেই ১৫ ডিগ্রির বেশি হবে না। বিশেষত, মেয়েরা প্রায়ই অন্ধ অনুকরণপ্রিয় ফ্যাশনের বশবর্তী হয়ে উঁচু বা সূঁচলো হিলওয়ালা (Stiletto) জুতো পরেন। এর ফলে তাঁদের দেহ অস্বাভাবিক কোণে ঝুকে থাকে। দেহের ভারসাম্য নষ্ট হয়, ভারবহন অক্ষ ডান কিংবা বাঁ পাশে সরে যায়, এ থেকে পায়ে, কোমরে ও পিঠে ব্যথা হয়।
এডিনবার্গ রয়েল কলেজ অব সার্জারি-র বিখ্যাত কাইরোপডি (Chiropody) গবেষক ইয়ান বি ম্যাকলুডের মতে, হাইহিল জুতো পরার জন্য মেয়েদের পেলভিসে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। নিতম্ব অঞ্চলের ইলিয়াম, পিউবিস, ইসচিয়াম অস্থিতে ও ত্রিকোণাকার শ্রেণীচক্রের বিশেষত, স্ক্যারোইলিক সন্ধিতে খুব চাপ পড়ার ফলে, প্রসবকালীন নানারকম অসুবিধা দেখা দেয়। এঁদের ক্ষেত্রে অনেক সময় সন্তান প্রসবের উপযুক্ত পথ না থাকার জন্য সিজার (Ceasareain Birth) পর্যন্ত করতে হয়। হিল তোলা জুতো পরলেও সারাদিন একই জুতো পরা উচিত নয়। দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হিলের জুতো পরা ভাল। দেখা যাচ্ছে, সামান্য জুতো থেকে কত ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে, সে কারণেই জুতো পছন্দের সময় ফ্যাশনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভাল-মন্দের দিকটাও একটু ভেবে দেখা দরকার।