উত্তরবঙ্গের হাল খুবই হতাশাব্যঞ্জক , ,

উত্তরবঙ্গের হাল খুবই হতাশাব্যঞ্জক , ,

বিজ্ঞান সচেতনতার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের হাল খুবই হতাশাব্যঞ্জক; ডাঃ পার্থপ্রতিম;  ৩৪১ সংখ্যা  ১৪ বৈশাখ ১৪১২ (বৃহস্পতিবার) উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
গতবছর (২০০৪-০৫) পালিত হল ‘বিজ্ঞান সচেতনতা বর্ষ’ হিসাবে। আমরা কতদূর অগ্রসর হলাম কুসংস্কার-ধর্মান্ধতা দূরীকরণের কাজে? আর কত কাজ রয়ে গেল বাকি? উত্তরবঙ্গের পটভূমিতে জনবিজ্ঞান আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হতে পারে? এইসব বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ডাঃ পার্থপ্রতিম মুখোমুখি হয়েছিলেন ডঃ অমিত চক্রবর্তীর। ডঃ চক্রবর্তী তিন দশকের জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক। ‘বিজ্ঞানমেলা’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আকাশবাণী কলকাতার প্রাক্তন কেন্দ্র অধিকর্তা। কলকাতা দূরদর্শনের পূর্ব চিফপ্রডিউসার। ভারত সরকারের এন সি এস টি সি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক ২০০১ সালে জাতীয় বিজ্ঞান পুরস্কার প্রাপক। ভারত সরকারের বিজ্ঞান প্রসার-এর পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ফেলো।

ডাঃ পার্থপ্রতিম:- বিজ্ঞান সচেতনতা বা বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলনের শুরু বলতে কী বোঝায় ?
     ডঃ চক্রবর্তী : ৭০- এর দশকে রাজনৈতিক উদ্দমতার পর যারা ভেবেছিলেন বন্দুকের নল দিয়ে দেশের সমাজব্যবস্থা পাল্টে দেবে ; পরবর্তীকালে তারা অনুভব করলো-জনসাধারণের মানসিকতা ও উপলব্ধির পরিবর্তন না করতে না পারলে, যুক্তিবাদের বিকাশ না ঘটালে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই সেই সব পরিবর্তনকামী যুবক-যুবতী, বুদ্ধিজীবি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। তারা কেউ আসে নাটকে, কেউ বা গণসংগীত সৃষ্টিতে, কেউ বা আবার বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলনে। গোবরডাঙ্গা রেনেসাঁস ইন্সটিটিউট-এর ব্যবস্থাপনায় ১৯৭৯ সালে প্রথম সর্বভারতীয় বিজ্ঞান ক্লাব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গায়। এই সম্মেলনে গঠিত হয় ইস্টার্ন ইন্ডিয়া সায়েন্স ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন (ইসকা)। তারপর বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে গড়ে ওঠে বিজ্ঞান ও নেচার ক্লাব। শুরু হয় বিজ্ঞান প্রদর্শনী, আকাশ দেখা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ শিবির, বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক পদযাত্রা আরও বহু কিছু। ১৯৮৬ সালে ২৯ নভেম্বর কলকাতা রাজ্য যুবকেন্দ্রে এক কনভেনশনে তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ।

ডাঃ পার্থপ্রতিম:- বিজ্ঞান সচেতনতা আন্দোলনের  বর্তমান পরিস্থিতিটা কেমন মনে করেন ?
    ডঃ চক্রবর্তী : প্রথমদিকে বিজ্ঞান আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল অভ্যন্তরীণ তাগিদ। চিন্তাশীল-সমাজসচেতন মানুষেরা ভাবতো সাধারণ মানুষের মন থেকে ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করা তাদের এক নৈতিক কর্তব্য। সেই যে চেতনার জায়গাটা এক সময় ছিল আজ তা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছে। আজ সব অনুষ্ঠানই অনুদান নির্ভর। সরকারি বা বেসরকারি অনুদান সাহায্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানকর্মীরা। এখন গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান করার চেয়ে শীত-তাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে সেমিনার আলোচনাতেই আমরা বেশি আগ্রহী।
    এবছর(২০০৪-২০০৫) পালিত হল ‘বিজ্ঞান সচেতনতা বর্ষ’ হিসাবে। সরকারি আনুকুল্যে অনেক সেমিনার হল, মেলা-প্রদশর্নী-বিতর্ক-ক্যুইজ প্রতিযোগিতা আরও কত কী ! বিষয়টি অনেকটা লেক্সপো বা বৈশাখী মেলার মতো। ধরা যাক, বিজ্ঞান রেলের কথা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটি বিজ্ঞান ট্রেন সারা দেশে ঘোরানো হল। কিছু সরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কী বা তেমন লাভ হলো ? শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস হলো, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানের মাতব্বরেরা আকাশপথে উড়ে গেলেন গৌহাটিতে। মিটিং হলো-ইটিং হলো সিটিং-হোল কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু কী পেল সেই সব দেশবাসী যাঁরা এখনও শহর থেকে দূরে রয়েছেন। এখনও জন্ডিস মহামারিতে ভিড় বাড়ে; হাসপাতালে নয় মায়ের থানে।

ডাঃ পার্থপ্রতিম:- এর বিকল্প হিসাবে আপনি কী ব্যবস্থা ভাবছেন ?
    ডঃ চক্রবর্তী : এই বিরাট পরিমাণ অর্থ দিয়ে যদি বিভিন্ন স্কুলগুলিতে স্বপ্লমূল্যের প্রশিক্ষণ উপকরণ (লো কস্ট টিচিং এডস) দেওয়া যেত তবে তা হতো খুবই উপযোগী। আজ বহু স্কুলেই বিশেষত মাধ্যমিক স্তরে স্কুলগুলিতে হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের নিরসভাবে বিজ্ঞান বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। ফলে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান সচেতনতার বিকাশ ঘটছে না। তৈরী হচ্ছে না জ্ঞানের প্রতি অনুসন্ধিৎসুতা। পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসাটাই বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্র। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে, নবীন প্রজন্মের মধ্যে এই সত্যনুসন্ধানের ভাবনা জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই প্রথাগত বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত অনেককেই দেখা যায় তাবিজ-কবজ পরতে। বিয়ের আগে ঠিকুজি কোষ্ঠী মেলাতে।

ডাঃ পার্থপ্রতিম:- জনবিজ্ঞান আন্দোলন কতটা সাফল্য পেয়েছে ?
      ডঃ চক্রবর্তী : জনবিজ্ঞান সংগঠনগুলির প্রয়াসে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। যেমন সাধারণ মানুষ আজ দল বেঁধে গ্রহণ দেখছে। জ্যোতিষবিদ্যা-ঠিকুজি-কোষ্ঠী বিচার এসব যে ভ্রান্ত অর্থহীন তা এখন জোর গলায় বলা যায়। আগে এটা বলা যেত না। ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে নাটক, পালাগান হচ্ছে। তবে আরো ব্যাপকভাবে এইসব কাজ চলা উচিত।
    তবে আজ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা যতটা না বেড়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা। এখন আমরা যে সমাজব্যবস্থার মধ্যে চলেছি, তা হল কনস্যুমারিজিম বা ভোগবাদী সমাজ। পৃথিবীর সব কিছু আমায় ভোগ করতে হবে। সব কিছুর ভালোটা আমার চাই! প্রয়োজনে অন্যকেও শোষণ করতে হবে-এটাও তো অবৈজ্ঞানিক চিন্তার সফল। সমাজের মেয়েরা যে আজ পিছিয়ে রয়েছে সেটাও যুক্তিহীন মানসিকতার কারণে। বিজ্ঞানটা সঠিকভাবে জানা নেই বলেই আমরা বুঝতে পারি না- পুরুষ ও মহিলা একে অপরেউর পরিপূরক। এখন পত্রিকার পাতা খুললে জ্যোতিষী-কোষ্ঠীবিচার-রত্ন বিক্রেতাদের রমরমা চোখে পড়ে। এমনকি টিভি চ্যানেল ভাড়া করে তারা নিজেদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এটা আমরা যারা জনবিজ্ঞানের কথা বলি তাদের কাছে বড় ব্যর্থতা। কম্পিউটারকে যদি বিজ্ঞানের একটি প্রতীক ধরি তবে কম্পিউটারকে মানুষ যেভাবে নিয়েছে বিজ্ঞানচেতনতাকে কিন্তু সেভাবে নেয়নি। কম্পিউটার দ্বারা হরোষ্কোপ বা কোষ্ঠী তৈরি করা হচ্ছে এটা কি কম্পিউটার তথা যুক্তিবাদী মানসিকতার ব্যর্থতা নয়?



ডাঃ পার্থপ্রতিম:-  বিজ্ঞান সচেতনতার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট কেমন?   
    ডঃ চক্রবর্তী : উত্তরবঙ্গের হালটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এমনিতে সাক্ষরতার তেমন প্রসার ঘটেনি। তাছাড়া রয়েছে আদিম বিশ্বাস-কুসংস্কার। ডাইনি-জলপড়া-তেলপড়া আরও কত কী। এসবের বিরুদ্ধে সুসংসঠিতভাবে জনবিজ্ঞান কর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।

ডাঃ পার্থপ্রতিম:- এ ধরনের কাজ তো সারা দেশেই প্রয়োজন, উত্তরবঙ্গের জন্য বিশেষ কোনো কর্মসূচীর প্রস্তাব?     
    ডঃ চক্রবর্তী : হ্যাঁ, উত্তরবঙ্গে এত বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে যাদের উপর তেমন ভাবে কাজ হয়নি। এখানে রয়েছে মোঙ্গলয়েড-নিগ্রোটো গোষ্ঠীর উপজাতি। বিজ্ঞান বা পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য হল পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করা। পরিবেশের মূল উপাদান হল মানুষ। আমরা পরিবেশের কথা বলতে গেলেই বাঘ-হাতি-গাছপালা-বন্য জন্তু-প্রাণীদের কথাই বলি। মানুষের কথাটা উহ্য রয়ে যায়। পরিবেশকে জানার জন্য পাশের বাড়ির মানুষটির আচার-আচরণ-সংস্কার-সংস্কৃতির জানাটা জরুরি। বিভিন্ন বিজ্ঞানমেলায় এই বিষয়গুলি তুলে ধরা দরকার।
    এছাড়াও উত্তরবঙ্গে রয়েছে এক বিপুল বায়োডাইভারসিটি। রয়েছে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের সুবিশাল ভান্ডার। কত বিরল প্রজাতির সাপ-অর্কিড এখানে পাওয়া যায় তার সঠিক হিসাব এখনও আমাদের জানা নেই। এইসব সম্পদের সুসংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবহারের কাজে বিজ্ঞান ক্লাব ও মঞ্চগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

 ডাঃ পার্থপ্রতিম:- এ সব ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা মিডিয়া কী ভূমিকা পালন করতে পারে?  
    ডঃ চক্রবর্তী : আজ বিজ্ঞানসচেতনতা প্রসারে অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান হয়েছে কিন্তু তেমন কোনো ভাল বিজ্ঞান পত্রিকা নেই। ‘সায়েন্স টুডে’-র মতো পত্রিকা আজ বন্ধ। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকাটি এখন অনিয়মিত। দশ-একাদশ লাখের পত্রিকাতে বিজ্ঞানের নিয়মিত পাতা থাকে না। কারণ এটা দিয়ে তেমন বাণিজ্য হয় না। তবে উত্তরবঙ্গ সংবাদ নিয়মিত ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ পাতা প্রকাশ করে চলেছে। এটা খুবই ভাল ব্যাপার। হতাশা শেষ কথা হতে পারে না। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। দরকার আরও সঠিক পরিকল্পনা ও তার আন্তরিক রূপায়ণ।   

Join our mailing list Never miss an update