হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৭; বিপদের নাম-সেরিব্রাল স্ট্রোক

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৭; বিপদের নাম-সেরিব্রাল স্ট্রোক

বিপদের নাম-সেরিব্রাল স্ট্রোক; -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
    ক্ষোভ হওয়ারই কথা। তিল-তিল করে গড়ে তোলা এই সাম্রাজ্যের পতন কী নিজের চোখে দেখা যায়? শৈশবের দিনগুলির ছবি আজও অজিতবাবুর চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে। অনেক সংগ্রামের পর দেশ স্বাধীন হলো। কারার ঐ লৌহ কপাট লোপাট করার আনন্দ কোথায়? সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ধূসর ছায়া। রাতের অন্ধকারে হলদিবাড়ি বর্ডার পেরিয়ে এদেশে ঢুকে ছিল বাবা-মা ও চার বাচ্চার পরিবার। তখন অজিতবাবুর বয়স কত হবে; খুব বেশি হলে বছর পনেরো। তারপর বিরাট এক লড়াইয়ের ইতিহাস। রেশন দোকান, ধানিজমি, পাটগুদাম আরো কত কী। এখন একমাত্র ছেলে বিজু এক এক করে সবই বেচে দিচ্ছে। লোকমুখে শোনা যায় এখন প্রতিদিন নাকি বিজুর মদ লাগে। এ নিয়ে বাপ বেটাতে বহুবার বচসা হয়েছে। গত পরশু রাগারাগি করতে করতেই অজিতবাবু হঠাৎ পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার আসে, তারপরেই নার্সিংহোমে। ডাক্তারবাবু জানালেন এটি ব্রেন স্ট্রোক (Brain Stroke)।
    ডাক নাম ‌'ব্রেন স্ট্রোক' হলেও ডাক্তারি ভাষায় একি বলি সেরিব্রো ভ্যাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট (Cerebrovascular Accident)। আমাদের দেহের অন্য অংশের মতো মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন রক্তধমনী। ব্রেন স্ট্রোক হলে এইসব ধমনীর মধ্যে রক্তজমাট বেঁধে যায়, নতুবা ধমনীর দেওয়াল ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধলে বলে সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস (Cerebral Thrombosis)। আর ধমনী ফেটে রক্তপাত হলে তার নাম সেরিব্রাল হেমারেজ (Cerebral Haemorrhage)।
উন্নয়নশীল দেশে ঘাতক তালিকায় সেরিব্রাল স্টোক তৃতীয় স্থান দখল করে আছে। ৫০ বছর বয়সের আগে এ রোগ প্রায় দেখা যায় না। পুরুষদের মধ্যে এর প্রবণতা মহিলাদের তুলনায় দেড়গুণ। প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশের ক্ষেত্রে সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস ও ১৫-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে সেরিব্রাল হেমারেজ থেকে ব্রেন স্ট্রোক হতে দেখা যায়।যে সব কারণে ব্রেন স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায় সেগুলি হলো-
উচ্চ রক্তচাপ * ডায়াবিটিস মেলিটাস * হাইপার লিপিডিমিয়া (Hyperlipidaemia) বা রক্তে চর্বির আধিক্য * পলিসাইথিমিয়া বা রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি * থ্রম্বোসাইথিমিয়া (Thrombocythaemia) বা প্রবাহিত রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধি  * ধূমপান।
    এছাড়াও আর যেসব ফ্যাক্টর ব্রেন স্ট্রোকের ক্ষেত্রে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- * ট্রমা (Trauma) অর্থাৎ মানসিক বা শারীরিক আঘাত * মদ্যপান * মহিলাদের ক্ষেত্রে হরমোনযুক্ত গর্ভনিরোধক পিল খাওয়া * পারিবারিক ইতিহাস।
    ডাক্তারি শাস্ত্রে রোগের তীব্রতা ও লক্ষণ অনুসারে সেরিব্রাল স্ট্রোককে মোটামুটিভাবে তিনভাগে ভাগ করা হয়-
কমপ্লিটেড স্ট্রোক (Completed Stoke) : সে হেমারেজ বা থ্রম্বোসিস যাই হোক না কেন, এই স্ট্রোকের লক্ষণগুলি ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে থাকে। স্ট্রোক হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে উপসর্গগুলি দেখা দিতে শুরু করে এবং এক থেকে দু’ঘন্টার মধ্যে চরমরূপ নেয়। মাথাব্যথা, হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া, অসাড় পায়খানা-প্রস্রাব, মৃগী রোগীর মতো অচৈতন্যভাব, কোমা এসব দেখা দিতে পারে।

ঈভলভিং স্ট্রোক (Evolving Stoke): এই স্ট্রোকের আক্রমণ হঠাৎ করে হয় না। উপসর্গগুলি ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে দেখা দেয় ও শেষে মারাত্মক আকার নেয়। ব্রেনের টিউমার, মস্তিষ্কের ডুরাম্যাটার ও অ্যাবাকনয়েডের মধ্যবর্তীস্থলে রক্ত সঞ্চয় হলে এ ধরনের ব্যাধি দেখা দেয়। অনেক সময় ইন্টারন্যাল ক্যারোটিড (Internal Carotid) অথবা মিডিল সেরিব্রাল ধমনী (Middla Cerebral Artery)-র ভেতর রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হলে ও আরো বহু কারণে ঈভলভিং স্ট্রোক হতে পারে।
ট্র্যান্সিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক (Transient Ischaemic Attack): মস্তিষ্কে পুষ্টি ও অক্সিজেনের অভাব এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী অসুবিধার সৃষ্টি করে। হৃদযন্ত্রের করোনারি ধমনীর মতো মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর ভেতর আথেরোসক্লেরোসিস (Atheros-clerosis) বা অ্যাথেরোমা (Atheroma) থেকে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হতে পারে। এ রোগের উপসর্গগুলি কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত থাকে। মাথাঘোরা, একটি বস্তুকে দুটি দেখা (Diplopia), অ্যাটাক্সিয়া (Ataxia) বা পেশি সমূহের অসমক্রিয়া, স্বল্পক্ষণের জন্য অজ্ঞান হওয়া।
    ব্রেন স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রোগীকে দেখে বোঝা যায় না স্ট্রোকটি হেমারেজ থেকে হয়েছে না থ্রম্বোসিস থেকে হয়েছে। কোমরের মাংসপেশী ফুটো করে সেখান থেকে সুষুন্মাকান্ডের রস বা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িড (Cerebro spinalfluid) পরীক্ষা করলে এটি সনাক্ত করা সম্ভব। মস্তিষ্কের কমপিউটার টোমোগ্রাফি (C.T.Scan) স্ট্রোকের অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত ব্যবস্থা। এছাড়াও এম. আর. আই (M.R.I.), অ্যাঞ্জিওগ্রাফি প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
 

   সেরিব্রাল অ্যাটাকের লক্ষণ বিভিন্ন হতে পারে। এটি নির্ভর করে মস্তিষ্কের যে অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার কাজের ওপর। মস্তিষ্কের যে অঞ্চল থেকে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন নিয়ন্ত্রিত হয় তা আক্রান্ত হলে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। শরীরের বাম বা ডান যে কোনো একপাশে পক্ষাঘাত হতেও দেখা যায়। মস্তিষ্কের যে দিক ক্ষতি হয় কার ঠিক বিপরীত দিকে এটি ঘটে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়  একে বলে হেমিপ্লেজিয়া (Hemiplegia)। আসলে মস্তিষ্কের ডান অঞ্চল থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় বাঁ-দিকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, একইভাবে ডান হাত-পা চলে বাম মস্তিষ্কের নির্দেশে।
    সেরিব্রাল স্ট্রোকের অন্যতম উপসর্গ অচেতন নিদ্রা বা কোমা (Coma)। ব্রেন স্ট্রোকে অক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে কোমা অবস্থা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক বছর চলতে পারে। অচৈতন্য অবস্থার মাত্রা থেকে চিকিৎসকেরা রোগাক্রমণের তীব্রতা বুঝতে পারেন। কোমার গভীরতা বুঝতে ডাক্তারবাবুরা বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। কোমা অবস্থা ও মৃত্যুর বিপদ কাটিয়ে ওঠার পর রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠতে থাকে। প্রথম দিকের মুখের ও জিভের অপ্রতিসমতা (Asymetry) ঠিক হয়ে আসে। তারপর পায়ের নাড়াচাড়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়। শেষে হাত নড়াচড়া করা সম্ভব হয়। আসলে মস্তিষ্কের কোনো একটি রক্তনালী অবরুদ্ধ হলে তার পাশাপাশি নালীগুলি স্বাভাবিকভাবেই স্ফীত হয়ে রক্ত সরবরাহ আগের মতো রাখতে চেষ্টা করে। সে কারণেই স্ট্রোকের পর রোগী নিজে থেকেই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। তবে দেখা গেছে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতের আঙ্গুল রোগী আগের মতো কাজে লাগাতে পারে না।

    সেরিব্রাল স্ট্রোকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর জ্ঞান ফিরে আসার পর সবার প্রথমে ডাক্তারবাবুরা রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে জেনে নেন রোগীর কোন্ কোন্ অঙ্গ আক্রান্ত হয়েছে। এর সঙ্গে অন্য কী কী অসুবিধা রয়েছে তাও দেখে নেওয়া হয়। যেমন-জ্ঞান আসার পর যদি দেখা যায় রোগীর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে (Retention of Urine), তবে প্রস্রাব হওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। অর্থাৎ রোগীর উপসর্গের ওপর নির্ভর করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়ে থাকে। স্ট্রোকের রোগীকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ও এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তিনি হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারেন। দেহের কোনো পাশে পক্ষাঘাত হলে রোগীকে মাঝে মাঝে চেয়ারে বসিয়ে দিতে হবে। মালিশ করলে পেশীতে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। কথার জড়তা বেশ কিছু দিনের মধ্যে না কাটলে স্পিচ্ থেরাপি (Speech Theropy)-র সাহায্য নিতে হয়। রক্তচাপ যাতে বেশি ওঠানামা না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। এ সময় চিকিৎসকেরা রোগীর ব্লাডপ্রেসার স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি রাখতে চেষ্টা করেন।
হৃদযন্ত্রের কারোনারি ধমনী সরু হতে থাকলে যেমন অ্যানজাইনা পেক্টোরিস ও আরো কিছু উপসর্গ হাজির হয়, ঠিক একইভাবে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহের মাত্রা কমে আসতে থাকলে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা দেখা দেয়। রোগীর বুদ্ধিমত্তা (Intellect) কমে যায়। বর্তমানের বিভিন্ন কাজকর্ম ভুলে যান, কিন্তু অতীত দিনের ঘটনা গুলি বেশ মনে পড়ে। নতুন পরিবেশে রোগী নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। অনেকটা রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে যায়। অল্পেতে রেগে যাওয়, সহজে উদ্বিগ্ন হওয়া, অল্প শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এসব লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকক্ষেত্রে রোগীর পদক্ষেপ কমে আসে। অর্থাৎ হাঁটার সময় দু’পায়ের মাঝের ব্যবধান কমে যায়। একই দূরত্ব চলতে তাকে বেশি বার পা ফেলতে হয়।
    এ ধরনের লক্ষণ যদি আপনার প্রিয়জনের মধ্যে চোখে পড়ে তবে আর দেরি না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। রোগ সমন্ধে সচেতনতা  ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন; প্রতিহত করতে পারে সেরিব্রাল স্ট্রোকের মতো ভয়ংকর ব্যাধিকে। এই মুহূর্ত থেকেই সজাগ হোন। বেদনাঘন রাগ-রাগিনী নয়; আপনার হৃদয়তন্ত্রীতে অবিরাম বেজে চলুক পিলু, ইমন, কল্যাণ, দরবারি, কানাড়া....।

Join our mailing list Never miss an update