হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৬; হৃৎপিন্ড সংস্থাপন ও কৃত্রিম হৃদয়

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৬;  হৃৎপিন্ড সংস্থাপন ও কৃত্রিম হৃদয়

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৬;  হৃৎপিন্ড সংস্থাপন ও কৃত্রিম হৃদয়; ডাঃ পার্থপ্রতিম।
    কে জানে এটাই হয়তো প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। ধ্বংসের ভেতর লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির বীজ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক নেশায় মানুষ যখন মত্ত হয়েছে তখনই আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন নতুন ওষুধ, জীবনদায়ী  প্রযুক্তি, আরো কত কী। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই ভালোভাবে দেখা গেছে। মনে পড়ে সেই পুরোনো ইংরাজি প্রবাদ-‘Necessity is the mother of Invention’। মোটামুটিভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় মানুষের বিকল দেহযন্ত্র পাল্টে দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়। প্রথম দিকে বানর, হনুমান, শূকরের অঙ্গ এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন সাফল্য আসেনি। এর অন্যতম কারণ মনুষ্যেতর প্রাণীর দেহাংশ মানুষের দেহে সংস্থাপন করলে তা মানবদেহ প্রত্যাখান করে। এমন কী এক মানুষের শরীরে অপর মানুষের দেহাংশ লাগালে একই ঘটনা ঘটে।

    তখন ১৯৬৭ সাল। ৩রা ডিসেম্বর তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে গ্রেটেস্যুর হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জেন ডঃ ক্রিশ্চিয়ান বার্নাড ও তার সহযোগীরা পঞ্চাশ বছর বয়স্ক লুই ভাসকানস্কি নামে এক বৃদ্ধের শরীরে অপর এক সদ্যমৃত ব্যক্তির হৃৎপিন্ড সংস্থাপনে সক্ষম হন। ভাসকানস্কি সাহেব প্রায় একমাস বেঁচেছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ এক নতুন যুগের সূচনা করে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নরম্যান স্যামওয়ে ও ডঃ ডেন্টন কুলী আরো বহু রোগীর হৃদযন্ত্র পালটে দেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের রোগীরা দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে নি। এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের দেহের ভেতরে থাকা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি সিস্টেম বাইরে থেকে আসা রোগ জীবানুকে যে ভাবে দেহের বাইরে বার করে দেবার চেষ্টা করে, ঠিক একই ভাবে অন্যের হৃৎপিন্ডকেও তারা প্রত্যাখ্যান করে। তাই এ ধরনের অপারেশনের পর রোগীকে সারা জীবন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূরীকরণের ওষুধ (Immuno Suppress Drug)  ব্যবহার করে যেতে হয়।

    এই অপারেশনের সময়, হৃৎপিন্ডের রক্তবাহী নালীর যোগাযোগ খুলে হার্ট-লাঙ্ মেশিনের সঙ্গে যুক্ত করে রক্তসঞ্চালনকে চালু রাখা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই অপারেশন। রোগগ্রস্ত হৃদযন্ত্রের ডান অলিন্দের পেছনের অংশ, ঊর্ধ্ব ও নিম্ন মহাশিরা ঠিকমতো রেখে বাকি অংশের সঙ্গে দাতার হৃৎপিন্ড যুক্ত করা হয়। এ অপারেশনের সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হলো অপারেশনের কিছু পরেই সংযোজিত হৃদযন্ত্রটিকে কাজ শুরু করতে হয়।
তার ফলে সংস্থাপিত হৃদয়ের ক্ষত জোড়া লাগার জন্য কোনো বিশ্রামের অবকাশ পায় না। কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এ রকম অসুবিধা দেখা যায় না। কিডনি একটি স্থবির যন্ত্র। আর হৃদযন্ত্র দেহের মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল অঙ্গ। হৃদযন্ত্র সংস্থাপনের খরচ মোটামুটি ১৫ লক্ষ টাকা। এ ধরনের অপারেশনের পর রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় ১০ লক্ষ টাকা।

    এই সব বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নকল হৃদযন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়াসী হন। যদিও কৃত্রিম হৃদযন্ত্র তৈরির কথা বহুদিন থেকেই বিজ্ঞানীদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ১৯২৮ সালে নোবেল জয়ী ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার হেনরি ডেইল রক্ত সঞ্চালনের একটি সুন্দর যন্ত্র তৈরি করেন। গবেষণাগারে পশুদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া পরিচালনের ক্ষেত্রে এটি খুব সাফল্য পায়। বিখ্যাত মার্কিন বৈমানিক চার্লস লিন্ডবার্গের এক নিকট আত্মীয়া হৃদযন্ত্রের কপাটিকার রোগে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। এই অবস্থা দেখে লিন্ডবার্গ বিমান চালানো ছেড়ে দিয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে তৈরির কাজে। ১৯৩৫ সালে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আলেক্সি কারেল্- এর সহযোগিতায় একটি কার্যকরী নকল হৃৎপিন্ড তৈরি করতে সক্ষম হন। ১৯৩৭ সালে জন গিবন হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের কাজ চালানোর জন্য একটি যন্ত্র তৈরির চেষ্টা চালান। ১৯৫৩ সালে মানুষের হৃদযন্ত্রের অপারেশনের  সময় এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়। গিবন-এর আবিষ্কৃত হার্ট-লাঙ্ মেশিন  নামে এখনও ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
    ১৯৮১ সালে ডঃ কুলী এক ওলন্দাজ রোগীর দেহে বিজ্ঞানী টেটসুজো আকুৎসুরি তৈরি একটি নকল হৃদযন্ত্র বসান। রোগীটি প্রায় ৩৬ দিন জীবিত ছিলেন। আইওয়ার ডেন মোনিয়েসের ড: বার্নে বি ক্লার্ক-এর শরীরে প্রথম স্বয়ং সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদযন্ত্র বসানো হয়। সল্টলসরটার এর উটা মেডিকেল সেন্টারে অস্ত্রোপচারটি  করা হয় ১৯৮২ সালের ১-২ ফেব্রুয়ারি।
   
৭০ দশকের পর থেকেই বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ব্যাপক উন্নতি শুরু হয়। চিকিৎসাবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির মেলবন্ধনের ফলে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে। কমপিউটার প্রযুক্তির কল্যাণে আর্টিফিশ্যাল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধাকে কাজে লাগিয়ে স্বয়ংক্রিয় নকল হৃৎপিন্ড তৈরির প্রয়াস এখন সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করেছেন ২০০৮ সালের মধ্যেই বাজারে এসে যাবে কৃত্রিম হৃদয়। রেডিও, টিভি, মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের মতো মানুষের বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গ কিনতে পাওয়া যাবে দোকানে দোকানে। যার সাহায্যে লাঘব হবে রোগ কষ্ট, দীর্ঘায়াত হবে মানবজীবন। কিডনি চা-ই কিডনি, হার্ট চা-ই হার্ট...। ফেরিওয়ালার এমন ডাক শুনলে হয়তো মোটেই অবাক হবে না আপনার নাতি-পুতি।

Join our mailing list Never miss an update