হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৩; সব বুক ব্যথা হৃদরোগ নয়

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৩; সব বুক ব্যথা হৃদরোগ নয়

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩৩; সব বুক ব্যথা হৃদরোগ নয়
    হৃদরোগের প্রবণতা বিশ্বজুড়েই ক্রমবর্ধমান। আর ভোজনরসিক, আড্ডাবাজ, শ্রমবিমুখ, বাক্যপটু, ধূম্রপানে আশক্ত বাঙালির মধ্যে এর প্রভাব বেশি হবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু অসুখ আছে, যার উপসর্গ অনেকটা হৃদরোগের মতো। এসবেতেও বুক ব্যথা, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে বুক ব্যথা হলেই তা হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ ভেবে অতি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বহু ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা পরবর্তীকালে হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
    অতিরিক্ত রক্তাপ্লতা (Acute Anaemia) হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন নামক লৌহঘটিত কণার মাত্রা কমে যায়। এই হিমোগ্লোবিন ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে দেহের বিভিন্ন কোষে কোষে সরবরাহ করে। তাই অ্যানিমিক রোগীর শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি পূরণ করার জন্য হৃদযন্ত্রকে অতিদ্রুত বেশি পরিমাণ রক্ত পাম্প করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, কোনো কোনো সময় বুক ব্যথা দেখা দিতে পারে। অনেকে একে হৃদরোগের পদধ্বনি ভেবে অযথা ঘাবড়ে যান। রোগ নির্ণয় করে আয়রন ট্যাবলেট বা ঐ জাতীয় কিছু ওষুধ খেলে রোগী অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
    হৃদরোগের লক্ষণ হিসেবে যে বুক ব্যথা হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞান তাকে বলে অ্যানজাইনা পেকটারিস (Anjina Pectoris)। প্রকৃত অ্যানজাইনাকে যেমন অনেকে গ্যাসের ব্যথা বলে ভুল করেন, ঠিক তেমনি আবার বহু ক্ষেত্রে হাইপার অ্যসিডিটি (Hyper Acidity)-র উপসর্গকে কেউ কেউ হৃদরোগ ভেবে আতঙ্কিত হন। প্রকৃত অসুখ নির্ণয় করার জন্য রোগী আগে কয়েকদিন কী কী ধরনের খাবার খেয়েছে তা জেনে নেওয়া দরকার। কারণ খাদ্য-খাবারের সঙ্গে অম্বলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। পেপটিক আলসার (Peptic Ulcer)-এর লক্ষণ অনেকটা অ্যানজাইনার মতো। এছাড়াও গলব্লাডারে পাথর (Gallbladder Calculi), অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ বা প্যানক্রিয়েটাইটিস্ (Pancreatitis)-এ বুকে ব্যথা হতে পারে। প্যানক্রিয়েটাইটিসের সঙ্গে হৃদবেদনার খুব মিল আছে। অগ্ন্যাশয়ে ব্যথা সাধারণত বুকের সামনের দিকে ও পিঠে সমানভাবে হয়। রক্ত এনজাইম ও মূত্র পরীক্ষা করলে তফাৎ ধরা পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে ই.সি.জি করার দরকার হয়।

সাধারণত স্টমাক ও ডিওডিন্যাল আলসার (Duodenal Ulser)-এ বুকের মধ্যাস্থি (Sternum)-র নিচে ব্যথা হয়। এর প্রকৃতি অনেকটা জ্বালাজ্বালা ও খোঁচামারা। এটি প্রধানত খাওয়ার এক থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে হয়ে থাকে। সাধারণভাবে ঝাল-মশলা, তেল-ঘি বেশি খেলে এটি দেখা দিতে পারে। ঠান্ডা দুধ ও ক্ষারজাতীয় ওষুধ খেলে ব্যথার উপশম হয়।

    অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুসের ভেতরে থাকা ধমনী-শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে গেলে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অসহ্য বুক ব্যথা, কাশি, থুথুতে রক্তের দাগ দেখা যায়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলি পালমোনারি ইম্ব্যলিজম্ (Pulmonary embolism)। এই উপসর্গকে হার্ট অ্যাটাক বলে অনেকে ভুল করেন। তবে ই.সি.জি বুকের পি/এ এক্স-রে করলে রোগের প্রকৃত স্বরূপ জানা যায়।
    পাঁজরের হাড়ে বাত (Osteo Arthritis) হলে বা ঘাড়ের স্পন্ডিলাইটিস্ (Cervical Spondylitis)-এ; বিশেষত যেখান থেকে স্নায়ুতন্তুগুলি বেরিয়েছে তাতে বুকে ও বাঁ-হাতে ব্যথা হতে পারে। এই বেদনা অনেকটা বিদ্যুৎ ঝলকের (Shooting pain) মতো। মেরুদন্ডের বিশেষ বিশেষ অবস্থায় এই ব্যথা দেখা যায়। অনেক সময় হাঁচি-কাশিতে, গাড়ির ঝাঁকুনিতে ব্যথা বাড়ে। ঘাড়ের এক্স-রে করলে রোগ ধরা পড়ে।
    বুকে পাঁজরের হাড়ে ও সন্ধিতে অনেক সময় ব্যথা হয়। এই বেদনা বুকাস্থির ওপরদিকে তরুণাস্থি বা কার্টিলেইজ (Cartilage)-এও হতে পারে। অ্যানজাইনার সঙ্গে এর প্রভেদ হলো-এক্ষেত্রে ব্যথা একনাগাড়ে থাকে। আক্রান্তস্থান ফুলে ওঠে, লালচে হয় ও একটু চাপ দিলে ব্যথা খুব বেড়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা একে বলি টিতজ্যস্ সিন্ড্রোম (Tietze’s Syndrome)।
    আমাদের দেহের থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় থাইরক্সিন হরমোন। কোনো কারণে থাইরক্সিনের ক্ষরণ বেড়ে গেলে শরীরে বিপাকক্রিয়ার হার বেড়ে যায়। এরই ফলে বেড়ে যায় হৃদস্পন্দনের গতি। দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট ও বুক ধড়ফড়। অনেক সময় বুকে ভারীবোধ ও ব্যথা দেখা দিতে পারে। এটি হৃদযন্ত্রের কোনো অসুখ নয়, এর নাম হাইপার থাইরয়ডিজম (Hyper Thyroidism)। রক্তের টি-৩, টি-৪ ও টি.এস.এইচ. পরীক্ষা করে উপযুক্ত ওষুধ খেলে উপসর্গগুলি দূর হয়।
    হাঁপানি, নিউমোনিয়া এসব অসুখে ফুসফুস থেকে অক্সিজেন ঠিক মতো রক্তে মিশতে পারে না। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়; কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ বেড়ে যায়। শরীরের কোষগুলিতে অক্সিজেনের ঘাটতি সামাল দিতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এর ফলে বুক কাঁপা, হৃদস্পন্দনের ছন্দপতন, নিঃশ্বাসে কষ্ট, বুক ব্যথা এসব উপসর্গ দেখা দেয়। একে অনেকে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ ভেবে ভুল করেন।
    এছাড়াও হায়াটাস হার্নিয়া (Hiatus Hernea) নামে একটি অসুখ আছে যার লক্ষণগুলির সঙ্গে হৃদরোগের মিল রয়েছে।
    মোদ্দা কথা হলো অভিজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করে শুধুমাত্র লক্ষণ দেখে হৃদরোগ ভেবে আতঙ্কিত হবেন না। কারণ চিকিৎসকেরাই জানেন আপনার রোগের প্রকৃত স্বরূপ কী। এসব ক্ষেত্রে নিজের ডাক্তারি নিজে করা মানে- "যমরাজকে আমন্ত্রণ করা . . .।"

Join our mailing list Never miss an update