হৃদয়ের কথা পর্ব-৩২; হৃদরোগীর যৌন জীবন

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩২; হৃদরোগীর যৌন জীবন

হৃদরোগীর যৌন জীবন; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১১ই অক্টোবর ১৯৯৯; পৃষ্ঠা -তিন; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    জীবনটাই হলো একটি সংগীত। এত আভোগ আছে, স্থায়ী আছে। আছে অন্তরা সঞ্চারী। কে না জানে-অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান মানুষের প্রাথমিক চাহিদা। তারপরেই আসে যৌন আকাঙ্খা পূরণের প্রয়াস। হৃদরোগীর যৌন আচরণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
    হৃদরোগীর যৌন জীবন নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সুইম্যান (Dr. Scheimann) জোর গলায় বলেছেন-“যৌন মিলন হৃদরোগীর কাছে একটি সুন্দর ব্যায়াম।” অন্যদিকে একদল কার্ডিওলজিস্ট বলেন-“যৌন মিলনের সময় হৃদয়ের স্পন্দন স্বাভাবিক অবস্থা থেকে দ্রুত হয়, হৃদযন্ত্রকে বেশি পরিমাণ রক্ত সারা দেহে সরবরাহ করতে হয়। তাই যাদের ইস্কিমিক হার্ট বা করোনারি হার্ট ডিজিজ আছে, তাদের এ সময় সাবধানতা অবলম্বন কার উচিত।” বিভিন্ন সমীক্ষা চালিয়ে তারা যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তা থেকে জানা যায়- যৌন মিলনের দু’ঘন্টা পরে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা প্রায় দ্বি-গুণ। তবে যে সব হৃদরোগী প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার পথ হাঁটাচলা করেন, তাদের যৌন জীবনে এই আশঙ্কা অনেক কমে যায়।
    হৃদরোগীর যৌন মিলনের ক্ষেত্রে তার সঙ্গী বা সঙ্গীনীকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। এ বিষয়ে মোটেই তাড়াহুড়া করা চলবে না। সমস্ত প্রক্রিয়াটি হবে খুব ধীরে ও শান্তভাবে। এ সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, রোগীর বুকে বা পেটে যেন বেশি চাপ না পড়ে। কোনো অবস্থাতেই পেট ভরে খাওয়ার একঘন্টার মধ্যে যৌন সঙ্গম করা উচিত নয়।
    আপনার করোনারি ধমনীর অসুখ, ইস্কিমিক হার্ট বা অন্য যা কিছু হৃদরোগ থাকুক না কেন সপ্তাহে একবারের বেশি মিলিত হবেন না। যৌন সঙ্গম শুধু দুটি শরীরের মিলন নয়, দুটি মনেরও মিলন। এতে দু’জনের মানসিক আবেগ-অনুভূতি-আকাঙ্খা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তাই মিলনের আগে পূর্বরাগ অত্যন্ত জরুরি।
    বিভিন্ন প্রকার গবেষণা চালিয়ে কার্ডিওলজিস্টরা মোটামুটি একমত হয়েছেন যে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াক ইনফ্রাকশনের পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ পরে নিরাপদে যৌন সঙ্গম করা যায়। যাদের হৃদযন্ত্রের করোনারি আর্টারিতে বাইপাস সার্জারি হয়েছে তারা সাধারণভাবে অপারেশনের ছয়-সাত সপ্তাহ পর স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। তবে সব কিছুই নির্ভর করে রোগের তীব্রতা, গুরুত্ব ও হৃদযন্ত্রের অবস্থার ওপর।
    হৃদরোগ হলো মন ও শরীরের ব্যাধি যাকে বলে সাইকোসোমাটিক ডিজিজ। মনের উৎকন্ঠা, ভয়, সংশয় হৃদয়ের অন্যতম শত্রু। তাই অবৈধ সংসর্গ হৃদরোগীর পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। এছাড়াও মিলনস্থলের যথেষ্ট নির্জনতা (Privacy)  থাকা প্রয়োজন।
    হৃদরোগীর বেশি রাত করে খাওয়া ও বেশি রাত করে ঘুমাতে যাওয়া মোটেই ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর মিলিত হওয়া উচিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন ভোরের দিকে এটা করা ক্ষতিকর। কারণ, শরীরজুড়ে সঙ্গমজনিত ক্লান্তি সারাদিন থাকতে পারে। যারা করোনারি হার্ট ডিজিজ্, ভালভিউলার হার্ট ডিজিজ্ বা অন্য কোনো হৃদয়ের অসুখে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় যৌন মিলন ঠিক নয়। আমাদের দেশে একটি বড়ো বিভ্রাট হলো-হৃদরোগী বা তার স্বামী-স্ত্রী লজ্জাবশত চিকিৎসকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন না। আর চিকিৎসকেরাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চান না।
    হৃদরোগের সঙ্গে ভগ্নহৃদয়ের এক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের একদল মনস্তত্ববিদ্ পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া পাঁচ হাজার বিধবা মহিলার ওপর সমীক্ষা করে দেখেছেন-স্বামীর মৃত্যুর ছ’মাসের মধ্যে প্রায় তিনশো জন মহিলা হার্ট ডিজিজে মারা গেছেন গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, স্বামীর মৃত্যুতে মনোকষ্টজনিত হৃদরোগের সম্ভাবনা স্ত্রীর মধ্যে যতটা প্রবল, স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর স্বাস্থ্যের ওপর ততটা প্রভাব পড়ে না।
    হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, এই সমীক্ষাটি পাশ্চাত্যের মানুষের ওপর করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রকৃত স্বরূপ মোটামুটিভাবে উপলব্ধি করা যায়। গ্রাম্য প্রবাদ আছে- ‘ভাগ্যবানের বৌ মরে, অভাগীর মরে স্বামী।’
    আসলে হৃদরোগীর শারীরিক ও মানসিক সব সুবিধা অসুবিধাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সর্তক থাকতে হবে-কখনো বিরহানলে হৃদয়বীণার তার ছিড়েঁ না যায় পাছে।

Join our mailing list Never miss an update