হৃদরোগী ও তার পারিপার্শ্বিক; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৩ই এপ্রিল ১৯৯৮; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
আজ ফাগুন লেগেছে বনে-বনে..। ধনী-গরিব, ছেলে-মেয়ে সবাই মেতেছে রঙের খেলায়। শিমূল-পলাশ রঙ দিয়েছে সবার মনে। খুশির জোয়ার লেগেছে কচি-ধেড়ে সবার মাঝে। অমরবাবু সকালবেলাটা কাটিয়েছেন বেশ ছুটির মেজাজে। দুপুরে খাওয়ার পর মাথাটা ভার হয়ে আসে, বাঁ-হাতটা কেমন ঝিন ঝিন করতে থাকে। বুকের ওপর যেন কিছু চেপে বসে আছে। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে, বমি করতে গিয়ে ওঠে, বমি করতে গিয়ে পড়ে যান। তারপরেই অজ্ঞান।
খবরটা পাড়ার মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অমর ভট্টাচার্য বেশ মাতব্বর গোছের মানুষ। তার স্ত্রী ততটাই গোবেচারা। ভীড় করে দলে-দলে আসতে থাকে লোক। এর মধ্যে কে একজন জলভরা কাঁসার বাটি বসিয়ে দিল তার নাদুস নুদুস পেটের ওপর। দত্তবাড়ির বড়ো গিন্নি শুরু করেছেন বিশেষজ্ঞের ভাষ্য-পেট গরম থেকে বমি, মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় আর কী কী হতে পারে। গতবছর সান্যালবাবু নেফ্রাইটিসের জন্য ভেলোর গিয়েছিলেন। মিসেস সান্যাল সে কাহিনী সগর্বে শোনাতে লাগলেন। এদিকে অমরবাবুর জ্ঞান ফিরে এল না, ডাক্তার এসে দুঃসংবাদটা শুনিয়ে গেলেন। বাড়ি জুড়ে উঠল কান্নার রোল।
হ্যাঁ, অনেক অমরবাবুই আর অমর থাকতে পারেন না। হৃদরোগের কারণে অকালে এই মমতাময়ী ধরাতল ছেড়ে চলে যেতে হয় পরপারে। আসলে হৃদরোগীকে নিজের সমন্ধে যেমন সতর্ক থাকতে হয়, তেমন তার পরিপার্শ্বিক অন্যসব লোকদেরও এ রোগের বিষয় স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। ডাক্তারের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে সঠিকভাবে জেনে নিতে হবে তার প্রিয়জনের হৃদয়ে কোন্ ব্যাধিটি বাসা বেঁধেছে। সেটি মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন, ইলেকট্রিক্যাল হার্ট ব্লক, কারোনারি হার্ট ডিজিজ বা অন্য কোনো রোগ হতে পারে। সে রোগ থেকে কী কী ভাবে বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটাও জানা দরকার।
বাড়িতে হৃদরোগী থাকলে পালস বা নাড়ী দেখাটা শিখে নিতে হবে। হাতের কবজির কাছে বুড়া আঙ্গুলের দিকে যে রেডিয়াল ধমনী (Radial Artery) থাকে তার ওপর তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকার সাহায্যে অল্প চাপ দিয়ে নাড়ী পরীক্ষা করা হয়। পুরুষের ডান হাত ও মহিলাদের বাঁ-হাতের নারী দেখাই ডাক্তারি রীতি। বেশির ভাগ হৃদরোগীর পালস অনিয়মিত থাকে। যেমন আপনি যদি নাড়ীর তালে তালে গুণতে থাকেন, তবে দেখবেন-১, ২, ৩-৫, ৬, ৭-৯ হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি তিনটি স্পন্দনের পর একটি স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে না। এ রকম ভাবে অনিয়মের মধ্যে কোনো নিয়ম আছে কী না সেটা খুঁজে বার করা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে আবার কোনো নিয়ম থাকে না। নাড়ীর অবস্থা থেকে রোগীর উন্নতি বা অবনতি অনেকটাই বোঝা যায়।
হৃদরোগীর সামনে তার পরিবারের লোকদের সবসময় হাসিখুশি থাকা উচিত। এতে রোগীর মানসিক স্ট্রেন অনেক কমে যায়। রোগী যা বলেন তা মন দিয়ে শোনা উচিত। রোগীর মতামত যদি পছন্দ না হয় তবুও প্রতিবাদ করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিভিন্ন সাংসারিক সুবিধা অসুবিধা নিয়ে মাঝে মাঝে রোগীর সাথে অলোচনা করা দরকার। তা না হলে যদি সে বুঝতে পারে তাকে কিছু গোপন করা হচ্ছে বা উপেক্ষা করা হচ্ছে- তবে আরো বেশি উদ্বিগ্ন হতে পারেন। সে সময় অ্যাড্রিনালিন (Adrenalin), কর্টিজল (Cortisol) প্রভৃতি হরমোন ক্ষরণ হয়, হৃদযন্ত্রের পক্ষে এর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। কোনো দুঃসংবাদ; যেমন প্রিয়জনের মৃত্যু বা দুর্ঘটনার খবর রোগীকে জানানোর আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
হৃদরোগীদের কখনই জোরে ডাকবেন না। ঘুমিয়ে থাকলে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে নেই। ঘুমের সময় বেসাল মেটাবলিক রেট (B.M.R.), রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দনের হার অনেক কমে যায়। রোগীকে অচমকা জাগালে-হৃদযন্ত্রের পেশিগুলি দ্রুত কাজ করার চেষ্টা করে। এই হঠাৎ বাড়তি চাপ আপনার প্রিয়জনের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে।
হৃদরোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে প্রথমেই পালস্ দেখতে হবে। পালস্ না পেলে-
১০ সেকেন্ডের মধ্যে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ শুরু করে দেবেন। ম্যাসাজ করার আগে রোগীকে শুইয়ে মুখে ঢুকিয়ে দেখবেন মুখে কিছু আছে কি না। সুপুরি, পান, থুতু বা অন্য কিছু থাকলে সরিয়ে দেবেন।
ডাক্তার ডাকবেন ও সেই সঙ্গে বুকে ম্যাসাজ করবেন। মুখে মুখ লাগিয়ে হাওয়া দেবেন। রোগীর নাকটা টিপে মুখটা হাঁ করে মুখে-মুখ লাগিয়ে দম নিয়ে দম ছাড়বেন। এটা এতটা জোরে হওয়া উচিত যাতে বুকটা ফুলে ওঠে।
তারপর ডান হাতের চেটোর শেষ অংশ দিয়ে বুকের মাঝের হাড় (স্টার্নাম-Sternam)-এর ওপর মালিশ করুন। মাটিতে বসে ডান হাতের চেটোটা বুকের ওপর রেখে তার ওপর বাঁ-হাত দিয়ে চাপ দিন। তবে খুব জোরে নয়। প্রতি তিন বা চার সেকেন্ড অন্তর। আর ছ-সাতবার এটা করার পর একবার মুখে হাওয়া দেবেন। কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিয়ে প্রায় ষাট শতাংশ হৃদ্ রোগীর আপদকালীন প্রাণরক্ষা করা সম্ভব।
হৃদরোগীর খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে প্রথম থেকেই সতর্ক থাকা দরকার। এ সংক্রান্ত কিছু সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকলে, তা ডাক্তার বাবুর কাছ থেকে সঠিক ভাবে জেনে নেওয়া উচিত। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কখনই বিজ্ঞজনের মতো ভাব করা উচিত নয়। মধ্যশিক্ষিতদের মধ্যে এই প্রবণতা খুবই দেখে থাকি। কোনো কিছু না জানার মধ্যে ততটা দোষ নেই, যতটা না জেনে বা ভাসাভাসা (Superficial) কিছু শব্দ জেনে বিজ্ঞ-বিজ্ঞ ভাব করাটা।
হৃদরোগীকে কখনই কুশল জিজ্ঞাসা করবেন না। উপরন্ত শারীরিক অলোচনা এড়িয়ে গিয়ে খেলাধূলা, রাজনীতি, সিনেমা প্রভৃতি হালকা বিষয় নিয়ে খোশগল্প করুন। রোগীকে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উপদেশ দেবেন না। সাধারণভাবে বয়স্ক লোকেরাই হৃদরোগের শিকার হন। কথায় বলে-‘নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।’ আপনি লম্বা-চওড়া উপদেশ দিলেন মানে শ্রোতাকে পাগলের অধম ভাবলেন। কারণে-অকারণে সুযোগ পেলেই উপদেশ দেওয়াটা আমাদের জাতীয় ব্যাধি। অর্থ দপ্তর যদি এর ওপর ট্যাক্স বসায় তবে কোনো বাজেটে আর ঘাটতি থাকবে না।
আমাদের একটা বদ স্বভাব আছে। কেউ অসুস্থ হলে সবাইমিলে দলবেঁধে তাকে দেখতে যাই। এটা অনেকটা উৎসবের মতো। এতে রোগী ভাবে তার অসুস্থতা মারাত্মক। রোগীর পাশে কখনই অযথা ভীড় করবেন না। সব সময় মনে রাখবেন হৃদব্যাধি অনেকক্ষেত্রেই মন-দেহ রোগ। যাকে আমরা ডাক্তারি পরিভষায় বলি সাইকোসোম্যাটিক ডিজিজ্ (Psychosomatic Disease)। নির্মল আনন্দ ও প্রশান্তিই হলো এ রোগের অন্যতম দাওয়াই।
হৃদরোগীর জীবন সুন্দর ও সাবলীল করতে রোগী ও তার পরিবারের উচিত এ ব্যাধি সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান আহরণ করা ও প্রয়োজনে কাজে লাগানো। তা না হলে, গোধূলি টপকে মধ্যাহ্নেই নেমে আসবে নিথর রাত্রি। ফিকে হবে জীবনের সব আবির-গুলাল- কুমকুম।