হৃদয়ের কথা পর্ব-২৯; রক্ত সংবহন ধারণার বিবর্তন

হৃদয়ের কথা পর্ব-২৯; রক্ত সংবহন ধারণার বিবর্তন

রক্ত সংবহন ধারণার বিবর্তন; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২১শে- ২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০০০; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    ঝোপঝাড়ের আড়ালে তেমনভাবে কিছুই চোখে পড়ে না। লতাগুল্ম নাড়িয়ে পাহাড়ের গুহা থেকে বেরিয়ে এল একদল স্তন্যপায়ী। দু’পায়ে ভর করে এগিয়ে আসছে। কারো কাছে পাথরের কুঠার, কেউবা পাথরের ফলা লাগানো বল্লম হাতে। ধুলো-ময়লায় জটপাকানো চুল, ঝোলানো চোয়াল, হাঁটার ভঙ্গি কিছুটা সামনে ঝুঁকে। উন্মুক্ত বুক-স্তন। শুকনো পাতা, গাছের বাকল বা পশু চামড়া দিয়ে শরীর অর্ধ আবৃত।
    না, এ আজকের নয়। স্মরণাতীত কোনো অতীতের কথা। তারপর কেটেছে বহু হাজার বছর। গুহা আশ্রয় থেকে বেরিয়ে মানুষ হয়েছে গগনচুম্বী। অট্টালিকা নিবাসী। সে যাই হোক, সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আমাদের দেহের সঙ্গে রোগের এক নিবিড় সম্পর্ক। শুধু মানুষ কেন? মনুষ্যেতর প্রাণীরাও বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে মানুষ শরীর ও শরীরের ভেতরে থাকা অসুখ নিয়ে বিভিন্ন সময় চিন্তিত, বিব্রত ও হতাশ হয়েছে। প্রাচীনকালে জ্ঞানের পরিধি ছিল খুবই সীমিত। দেহের ভেতর থাকা বিভিন্ন অঙ্গ-যন্ত্রের কাজকারবার তাদের কাছে ছিল অজানা। তখন রোগ নিরাময়ের প্রয়াস চলতো যাদুবিদ্যা, তুকতাক, সম্মোহন বিদ্যা, ডাইনি চর্চা, মাদুলি-কবজের মধ্য দিয়ে।
    প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও মিশরের পুরোহিতরাই ছিল চিকিৎসক। তারা মনে করতো অশরীরি আত্মা, ভূত, দানব এসব দেহের ওপর ভর করলেই রোগের সৃষ্টি হয়। তাই যাগযজ্ঞ, আরতি, বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচগান এসবই ছিল সে সময়কার রোগের দাওয়াই।
    চিনের সভ্যতাও সুপ্রাচীন। গৃহ নির্মাণ, নৌকা চালানো-এসবের সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যা চিনের বহুকাল আগের চর্চা। সে দেশে চিকিৎসা বিদ্যা ছিল দর্শনের (Philosophy) মতো। প্রাচীন চৈনিক দর্শন অনুসারে বিশ্বের যাবতীয় যা কিছু তা সৃষ্টি হয় ‘ইয়াং (Yang)  ও ইন (Yin)’ এই দুই বিপরীত ধর্মগুনের সমন্বয়ে। উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুয়ের দেহও এর বাইরে নয়। স্ত্রী ও পুরুষধর্মী ইয়াং ও ইন-এর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ঘটলে দেখা যায় রোগ, শারীরিক গোলযোগ। চৈনিক শরীরবিদ্যা (Physiology) অনুসারে দেহের সমস্ত অঙ্গের মধ্যে হৃদযন্ত্রই শ্রেষ্ঠ। যকৃৎ থেকে আবির্ভূত হয় হৃদয়, আর হৃদয় থেকে সৃষ্টি হয় পাকস্থলী। আর বৃক্ক বা কিডনির সঙ্গে হৃদযন্ত্রের সম্পর্ক হলো আদা-কাঁচকলা বা দা-কুড়ালের।
    চিনের প্রাচীনতম চিকিৎসাশাস্ত্র গ্রন্থটি হলো ‘নেই চিঙ’; যেখানে রক্ত সংবহনতন্ত্রের উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই গ্রন্থের রচয়িতা সম্রাট হুয়াং-তি, যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২৫০০ বছর আগে এটি রচনা করেন। এই গ্রন্থে রয়েছে ‘ইয়াং’ গুণই শরীরে রক্ত সংবহন পরিচালনা করে। ঘন্টায় ৫০ বার রক্ত ঘুরপাক খায়।
    নাড়ী দেখে রোগ নির্ণয় পদ্ধতি চিনে বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত। তখন চিকিৎসক বলতেই ছিল নাড়ীটেপা ডাক্তার এবং ব্যাপারটি ছিল খুবই জটিল। কারণ নাড়ীর বহু প্রকার গুণাগুণ তারা লক্ষ্য করতেন। শরীরকে মনে করতেন বহু তারওয়ালা সেতার বা এস্রাজের মতো। হাত, গলা, পা, এসব জায়গার নাড়ীগুলি বাদ্যযন্ত্রের এক একটা তার। বাদ্যযন্ত্রে তারগুলি ঠিকমতো সুরে আছে কিনা তা যেমন টোকা দিয়ে বোঝা যায়। সেভাবেই তারা নাড়ী টিপে বহু অসুখের হাল-হকিকৎ জানার চেষ্টা করতেন। চৈনিক চিকিৎসকেরা ছাব্বিশটি ‘মৃত্যু নির্দেশক নাড়ী’ চিহ্নিত করেন। এই নাড়ীতে হাত রেখেই তারা বুঝতে পারতেন কাকে যমরাজ সমন পাঠিয়েছেন। তবে ব্যাপারটি ছিল খুবই ধৈর্যের। অনেক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত এই নাড়ী পরীক্ষা করতে। আজও যারা তিব্বতীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন তারা এ পন্থা অনুসরণ করেন।
    পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা হলো গ্রিক সভ্যতা। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে থেকে শুরু করে খ্রিষ্টাব্দের দুই শতক পর্যন্ত একটানা প্রায় ৮০০ বছর গ্রিকরা জ্যামিতি, জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিতের সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যারও ব্যাপকচর্চা চালান। একথা স্বীকার না করে উপায় নেই, চিকিৎসা বিজ্ঞানে গ্রিকেরা যে অবদান রেখেছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিক মনীষীদের মধ্যে আলকমাওন, এমপিডক্লেস ও হিপোক্রেটিসের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মত। শরীর সংস্থান সম্পর্কে এমপিডক্লেস বলেন-‘রক্ত হৃৎপিন্ডের অভিমুখে আসে ও হৃদযন্ত্র থেকে দেহের বিভিন্ন প্রান্তে ফিরে যায়।’
   যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪৬০ বছর আগে চিকিৎসা জগতের কিংবদন্তী পুরুষ হিপোক্রেটিস জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ১০১ বছর বেঁচে ছিলেন। পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি লিখে গেছেন। যেমন- ‘কৃশকায় অপেক্ষা অতিশয় স্থূলকায় ব্যক্তির আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই প্রবল। চব্বিশ থেকে ষাট বছর বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সন্ন্যাসরোগের বিশেষ প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়।’ হিপোক্রেটিস হয়তো হার্ট অ্যাটাকের কথা বলেছিলেন। হিপোক্রেটিস শুধু যে একজন চিকিৎসক ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন চিকিৎসকের দার্শনিক। হিপোক্রেটীয় শপথ তাই চিকিৎসাবৃত্তিতে প্রবেশের পূর্বে সকল চিকিৎসককে নিতে হয়। আজও পৃথিবীর বহু দেশে এই প্রথা প্রচলিত আছে। এই শপথে বলতে হয় “..রোগীর সমস্ত প্রকার কল্যাণের জন্য আমি সবসময় সচেষ্ট থাকবো।... রোগীর গোপন কোনপ্রকার তথ্য প্রকাশ করবো না...।” যদিও আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগে এ শপথ কারো কারো কাছে নিছক কথার কথা হয়ে গেছে।
    প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে হিপোক্রেটিসের পরেই ক্লডিয়াস গ্যালেনের স্থান। ১৩০ খ্রীস্টাব্দে গ্যালেনের জন্ম হয়। তিনি রোমের রাজ চিকিৎসকের গুরুদায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীদেহ নিয়েও গবেষণা চালান। সেই সময়কার দার্শনিক মতবাদ ছিল মহাজাগতিক শক্তি থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘নিউমা’(Pneuma) উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের সব শক্তির উৎস। তৎকালীন স্টোইক দার্শনিকদের মতানুসারে নিউমা থেকে তৈরি হয় স্বাভাবিক শক্তি বা ন্যাচারাল স্পিরিট্ (Natural Spirit)। সেই ন্যাচারাল স্পিরিট্ জীবনীশক্তি বা ভাইটাল স্পিরিট্ (Animal Spirit) ও চিৎশক্তি বা অ্যানিম্যাল স্পিরিট্ এ ভাগ হয়ে জীবের জীবন ও মনন শক্তিকে গতিশীল রাখে।
  গ্যালনের অনুসন্ধানী মন এইসব দার্শনিক মতবাদকে তুচ্ছ করতে পারে নি। তিনি দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের ফলকে মিশিয়ে রক্ত সংবহন পদ্ধতির ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন- “ শরীরের ভেতরে থাকা যকৃৎ, শ্বাসতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকযন্ত্র এ সবের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মহাজাগতিক শক্তি নিউমা-কে ন্যাচারাল স্পিরিট্, ভাইটাল স্পিরিট্ ও অ্যানিম্যাল স্পিরিটে পরিণত করা। নিউমা যকৃতে স্বাভাবিক শক্তি, হৃদযন্ত্রে জীবনীশক্তি ও মস্তিষ্কে চিৎশক্তি রুপে বিরাজ করে। পরিপাক হওয়ার পর খাদ্যের সারবস্তু অন্ত্র থেকে যকৃতে এলে প্রথমে রক্তে পরিণত হয়। সেই রক্ত যকৃতে থাকা ন্যাচারাল স্পিরিটের সঙ্গে মিশে দেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধি সাধন করার গুণ অর্জন করে। যকৃতে তৈরি হওয়া রক্তের কিছু অংশ হৃৎপিন্ডের ডান নিলয়ে আসে। এখানে রক্তের ভেতর থেকে দূষিত গ্যাস ফুসফুসীয় ধমনী পথে বাইরে বেরিয়ে যায়। এই দূষিত গ্যাস প্রথমে ফুসফুসীয় ধমনী দিয়ে ফুসফুসে যায় পরে নাক-মুখ দিয়ে বাইরের বাতাসে মেশে। এইভাবে শুদ্ধ হওয়ার পর শিরার মধ্যে রক্ত নড়াচড়া করতে থাকে। তবে শিরার রক্ত সব সময় শিরার মধ্যে থাকে না। কিছু রক্ত শিরা থেকে দুই নিলয়ের ভেতরে থাকা দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে ডান নিলয় থেকে বাম নিলয়ে ঢুকে পড়ে। নিলয়ের প্রাচীরে রয়েছে ছোটো ছোটো ছিদ্র যেগুলি খালি চোখে দেখা যায় না।
    হৃদযন্ত্রের বাম নিলয়ে জীবনীশক্তিরূপে নিউমা বিরাজ করে। নিশ্বাসের সঙ্গে আসা বায়ু ফুসফুসীয় শিরার মধ্য দিয়ে হৃৎপিন্ডের বাম নিলয়ে আসে। এইখানে রক্ত আর বাতাস মিলে জীবনীশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ডান থেকে বাম নিলয়ে আসার পর ভাইটালস্পিরিট্-এর যাদুকাঠির ছোঁয়ায় রক্ত অতি উৎকৃষ্ট গুণ লাভ করে। এই উৎকৃষ্ট রক্ত ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও যন্ত্রকে প্রাণদান করে। রক্তের কিছু অংশ আবার মস্তিষ্কে গিয়ে অ্যানিম্যাল স্পিরিট্ বা চিৎশক্তি  অর্জন করে। মস্তিষ্কে রয়েছে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রক্তনালীর জাল যার নাম রেট্ মিরাবাইল (Rete Mirabile)। মস্তিষ্কের ঐ রেট্ মিরাবাইলের মধ্যে রক্ত ঢুকে চিৎশক্তি প্রাপ্ত হয়।” গ্যালেনের তত্ত্ব অনুসারে এই হলো আমাদের রক্ত সংবহনতন্ত্রের ব্যাখ্যা।
ক্লাডিয়াস গ্যালেন তার সংবহনতন্ত্রের ব্যাখ্যায় পরীক্ষা প্রমাণের বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রচলিত দার্শনিক তত্ত্বের আফিম মিশিয়ে একটি ককটেল পরিবেশন করেন। ঐশ্বরিক দর্শন ও বিজ্ঞানের যে সুন্দর মেলবন্ধন গ্যালেন তার বুদ্ধি দিয়ে করেছিলেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। পরবর্তীকালে বহু জ্ঞানী ও চিন্তাশীল মানুষ এই তত্ত্বকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেন। প্রায় দেড় হাজার বছর জুড়ে গ্যালেনীয় ভূত চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাঁধে চেপে বসেছিল। এরপর বহু চিকিৎসাবিদ হৃদযন্ত্রের গঠন ও তার কার্যপ্রণালী সম্পর্কে কিছু কিছু আলোচনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কেউই গ্যালেনের চেয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো তত্ত্ব দিতে পারে নি।
    একাধারে স্থপতি, পদার্থবিদ, গণিতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, জীববিদ্ ও দার্শনিক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) হৃদযন্ত্রের সংবহন নিয়ে মূল্যবান গবেষণা করেন। মানবদেহ নিয়ে তিনি যে সব ছবি বা স্কেচ আঁকেন তার এক চতুর্থাংশই হৃৎপিন্ডের ওপর। তিনি দেখেন যে, ফুসফুস হতে যে সব বায়ুনালীর শাখা-প্রশাখা বের হয়েছে তার সঙ্গে হৃদযন্ত্রের কোনো যোগাযোগ নেই। এই শাখা-প্রশাখা ক্রমেই বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে শেষে বায়ুথলি তৈরি করেছে। তার এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করার জন্য তিনি বাইরে থেকে বাতাস পাঠিয়ে ফুসফুসকে ফোলান। যদি ফুসফুসের বায়ুনালীর  সঙ্গে হৃৎপিন্ডের সরাসরি সম্পর্ক থাকতো তবে সেই বায়ু হৃদযন্ত্রে আসার কথা। কিন্তু তা হলো না। গ্যালেন তার ব্যাখ্যায় বলেছিলেন- “ফুসফুসীয় শিরা হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের বায়ুনালীর সাথে সরাসরি সংযুক্ত।” লিওনার্দো গ্যালেনের এই ভুল প্রথম প্রমাণ করেন। দ্য ভিঞ্চি হৃৎপিন্ডের ব্যবচ্ছেদ, অঙ্কন, ছাঁচ তৈরি এসব বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে, মহাধমনীর মূলে রয়েছে কপাটিকা বা ভালভ। তিনি আরো বলেন,“এই কপাটিকার জন্যই রক্ত সবসময় একদিকে প্রবাহিত হয়।” তারপর প্রমাণ করেন দুটি নয়; হৃদযন্ত্রে রয়েছে চারটি প্রকোষ্ঠ। এরপর লিওনার্দো কাচের তৈরি নকল হৃৎপিন্ড বানান। কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি রক্ত সংবহনতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার করতে পারেন নি। এর অন্যতম কারণ ছিল দ্য ভিঞ্চি গ্যালেনের ককটেল-এর নেশা পুরোপুরি ছাড়াতে পারেন নি। তবে হ্যাঁ, চিন্তাধারার অভিনবত্বে ও স্বকীয়তায় লিওনার্দো সমসাময়িককাল থেকেই অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। তিনি কোনো বই লেখেন নি, তবে তার আঁকা স্কেচ ও নোটবই পরবর্তীকালের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদদের মগজে বহু নতুন খোরাক জোগান দিয়েছিল।
    ইতালির পাদুয়ার গবেষক অ্যান্ডিয়া ভেসালিয়াস ১৫৪৩ সালে তার ডি ফ্যাব্রিকা (De Fabrica) বইতে গ্যালেনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। গ্যালেন সাহেব বলেছিলেন-“ বাম ও ডান নিলয়ের মাঝে থাকা পর্দা বা সেপ্টামে আছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র। এই ছিদ্র পথে রক্ত চলাচল করে।” ভেসালিয়াস হৃৎপিন্ড ব্যবচ্ছেদ করে দেখেন এই সেপ্টাম অতি নিরেট দেওয়ালের মতো, এখানে কোনো ফাটাফুটো নেই। ভেসালিয়াস তারপর লিখলেন-“হৃৎপিন্ডের নিলয়গুলির মধ্যবর্তী পর্দাটি খুবই পুরু ও নিরেট। কোনো একটি গর্তও ডান থেকে বাম নিলয়কে সম্পূর্ণভাবে বিদীর্ণ করে নি। চোখে দেখা যায় না এরকম ছিদ্র পথে রক্ত ডান হতে বাম নিলয় কিভাবে যেতে পারে! সৃষ্টিকর্তার এ কৌশলের কথা ভাবলে সত্যই আশ্চর্য হতে হয়।”
   
সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর এই কৃতজ্ঞতার মধ্যে আন্তরিকতা কতটুকু ছিল? যিনি রাতের পর রাত জেগে শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন, লুভ্যাঁ ও প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেলে ও মধ্যযুগীয় পাঠ্যক্রম ছিল বলে যার অনুসন্ধানী মন তৃপ্ত হতে পারে নি। তাই প্যারি ছেড়ে ইতালির পাদুয়ায় স্থায়ীভাবে গবেষণা করে সারাজীবন কাটিয়ে দেন। তার এই বশ্যতা স্বীকার? না, এখানে শেষ নয়...।
    ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হলো ‘ডি ফ্যাব্রিকা’ বইটির সংশোধিত, এখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় স্বীকারোক্তি দিলেন-“কিছুদিন আগেও গ্যালেনের ধারণা হতে একচুল বিচ্যুত হওয়ার মতো সৎসাহস আমার ছিল না। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, সেপ্টাম হৃৎপিন্ডের অন্যসব অংশের মতো পুরু-নিরেট ও ঘন সন্নিবিষ্ট। অতএব ক্ষুদ্রতম রক্ত কণিকাও কিরূপে সেপ্টামের ভেতর দিয়ে ডান হতে বাম নিলয়ে প্রবেশ করে তা আমার বুদ্ধির অগম্য এ ব্যাপারে অন্য সব তথ্য বিচার করলে রক্ত সংবহনতন্ত্র সম্বন্ধে আমাদের আরও অনেক সংশয় উপস্থিত হবে।”
    প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেসালিয়াসের সহপাঠী ছিলেন মাইকেল সের্ভেটাস (১৫১১-৫৩)। সের্ভেটাসের অনুসন্ধানী মন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লিখলেন ‘রেসটিটুটিও খ্রিস্টানিজম’ (Restitutio Christionism)। এই গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো বিরাট হট্টগোল। ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার জন্য প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথেলিক সম্প্রদায়ের মাতব্বরেবা সের্ভেটাসের মৃত্যুদন্ড দিলেন। ঘটে মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘটনা। ১৫৫৩ সালে জেনেভায় পুড়িয়ে মারা হলো বিজ্ঞানী সের্ভেটাসকে। জলন্ত চিতাতেই পোড়ানো হলো ‘রেসটিটুটিও খ্রিস্টানিজম’- এর সমস্ত প্রতিলিপি। ঘটনাচক্রে বইটির তিনটি কপি শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে যায়।
    গ্রন্থটির মূল বিষয় ধর্মীয় গোঁড়ামি হলেও চিকিৎসাশাস্ত্র, শরীরসংস্থান ও আরও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। গ্যালেনের মতবাদের সমালোচনা করে তিনি যে সব মন্তব্য করেন তা থেকে বোঝা যায় সের্ভেটাস রক্ত সংবহনতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ফুসফুসীয় রক্ত সংবহনের উল্লেখ প্রথম এই বইতে দেখতে পাই। গ্যালেনীয় মতবাদের বিরোধিতা করে তিনি বলেন- ‘‘রক্ত সেপ্টামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না। ডান নিলয় থেকে রক্ত বিশেষ পথে ফুসফসে যায়। আর ফুসফুসে পৌঁছে রক্তের রং হয় কিছুটা হালকা। ফুসফুসীয় ধমনী থেকে ফুসফুসীয় শিরায় যাওয়ার সময় উত্তেজিত বায়ুর সংস্পর্শে এসে রক্ত পরিস্কার হয়। এইভাবে শুদ্ধ রক্ত বাম নিলয়ে ফিরে আসে।” সের্ভেটাসের সমসাময়িক ইতালির রিয়েলদাস কলম্বাস ফুসফুসীয় সংবহন সমন্ধে একই মত পোষণ করেন।
    হিরোনিমাস ফ্যাব্রিসিয়াস (১৫৩৭-১৬১৯) রক্ত সংবহনতন্ত্রের রহস্য ভেদ করতে আরোও একধাপ এগিয়ে যান। তিনিও পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ১৬০৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘অন দ্য ভালভ অব দ্য ভেনস’ বইটি। এই গ্রন্থে তিনি বলেন যে, শিরার মধ্যে কিছুদূর পরপর অতি সূক্ষ ঝিল্লি বা মেমব্রেন আছে। এই ঝিল্লি এক মুখী কপাটের মতো কাজ করে। তাই রক্ত সবসময় একই দিকে প্রবাহিত হয়। এই রক্ত প্রবাহের অভিমুখ শিরা থেকে হৃৎপিন্ডে। তবে গ্যালেনের মতবাদের ওপর ফ্যাব্রিসিয়াসের আস্থা ছিল।
    অবশেষে গ্যালেনের প্রায় দেড় হাজার বছর পর উইলিয়াম হার্ভি (১৫৭৮-১৬৫৭) রক্ত সংবহনতন্ত্রের রহস্যের অবসান ঘটান। ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তার লেখা গ্রন্থ ‘ডি মোটু কর্ডিস ইট স্যানগুইনিস্’ (De Motu Cardis Et Sanguinis) প্রকাশিত হওয়ার পর বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে যায়। হার্ভি দেখান যে, হৃদযন্ত্র থেকে ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত বের হয়ে শিরার মধ্য দিয়ে চক্রাকার পথে আবার হৃৎপিন্ডে ফিরে যায়। হৃদযন্ত্রের এই পাম্পিং কাজ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে। হার্ভি লিখেছেন -‘‘যুক্তির বিচারে ও চাক্ষুষ পরীক্ষার দ্বারা আমি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ পেয়েছি যে, নিলয়গুলির চাপে রক্ত হৃদযন্ত্র থেকে দেহের সব অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। তারপর মাংসের ভেতরে থাকা ফাঁক ফোকর দিয়ে শিরায় ঢোকে। অবশেষে ফিরে আসে হৃদযন্ত্রে। প্রথমে ছোটো শিরা থেকে বড়ো শিরা । তারপর অল্প বড়ো থেকে অরো বড়ো শেষে মহাশিরার পথে হৃদয়ের ডান অলিন্দে প্রবেশ করে। পরিপাক হওয়া খাদ্যবস্তু থেকে সঙ্গে সঙ্গে এত বিপুল পরিমাণ রক্ত তৈরি হয় না। একই রক্ত চক্রাকারে সঞ্চালিত হয়। সংবহনের এই গতিকে অব্যাহত রাখাই হৃদযন্ত্রের কাজ।”
     হার্ভির মতবাদের মধ্যেও অনেক ফাঁক ফোকর ছিল। যেমন-ধমনী ও শিরার মাঝে থাকা রক্ত জালকের কথা তিনি কল্পনা করতে পারেন নি। হার্ভির পরবর্তীকালে ম্যালপিঘি, জ্যাঁ পেকে, রুডবেক, বার্থেলিন, গ্লিসেন, টমাস হোয়াটর্ন প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা রক্তের উৎপত্তি; বৃক্ক, অন্ত্র, পাকস্থলী এসব অঙ্গ বা যন্ত্রের মধ্য দিয়ে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন। তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পেছনে ছিল হার্ভির গবেষণা।
    হার্ভি বহুদিনের পুরাতন ভুল ভাঙ্গিয়ে দেওয়ার ফলে সপ্তদশ শতাব্দীর মানুষ সবকিছুকেই নতুনভাবে যাচাই করতে শুরু করে। শুধু শরীরবিদ্যাতে নয়, চেতনার এই ঢেউ সংস্কারের বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। বিজ্ঞান প্রকৃত অর্থে হয়ে ওঠে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত সত্যের সন্ধান। ধর্মের মতো স্থবির আপ্তবাক্যের স্থান এখানে নেই। তাই বিজ্ঞানের তথ্য বা তত্ত্ব যুক্তির নিরিখে সতত পরিবর্তনশীল। হ্যাঁ, এখানেই বিজ্ঞানের সাফল্য; এখানেই বিজ্ঞানের গর্ব।

Join our mailing list Never miss an update