হৃদয়ের কথা পর্ব-২৮; করোনারি কেয়ার ইউনিট

হৃদয়ের কথা পর্ব-২৮; করোনারি কেয়ার ইউনিট

করোনারি কেয়ার ইউনিট; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২০শে ডিসেম্বর ১৯৯৯; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’! -একে ঠিক তেমনভাবে বলা যাবে না। চুপিসারে কৃষ্ণ কালো মেঘ জমে পশ্চিম দিগন্তে। অবগুন্ঠনের আড়ালে থাকে বিজলি চমক। তারপর একদিন ঘটে বজ্রপাত।
    রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে গেলে তা ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে হৃদযন্ত্রের করোনারি ধমনীর ভেতর দেওয়ালে। প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহের অভাবে মাঝে মাঝে দেখা দেয় হৃদবেদনা বা অ্যানজাইনা পেক্টোরিস। অবশেষে ঘটে বজ্রপাত বা হার্ট অ্যাটাক।
    হার্ট অ্যাটাকে যত জন মারা যান তার শতকরা ৪০ জনের মৃত্যু ঘটে ২৪ ঘন্টার মধ্যে। তিন দিনের মধ্যে মারা যান ৭০ শতাংশ রোগী। আর শতকরা ৮৫ জনের মৃত্যু হয় প্রথম সপ্তাহে। হার্ট অ্যাটাকের পর রোগীর জীবন বাচাঁনোর জন্য প্রতি সেকেন্ড মূল্যবান। কয়েক মূহূর্ত দেরিতে চিকিৎসা শুরু করার জন্য রোগী চিরদিনের জন্য মর্ত্যলোক ছেড়ে চলে যেতে পারেন।

    আমাদের দেশে বিশেষত যারা মফস্বল শহরে বাস করেন তাদের হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা বেশ দেরি করে শুরু হয়। প্রথমত স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে রোগীর আত্মীয় পরিজন বা পারিপার্শ্বিক লোকজনেরা রোগের গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক সময় সামান্য কিছুতেই বাড়িতে ডাক্তার ডেকে শোরগোল তুলে দেন, আবার হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থাতে ডাক্তারের কাছে দেরি করে আসেন। ডাক্তারবাবু যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন না হলে তিনিও সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে পারেন না। শেষমেশ যখন রোগী উপযুক্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছায় ততক্ষণে ওয়েটিং লিস্ট-আর.এ.সি. পেরিয়ে পরপারের রির্জাভেশন কনফার্ম হয়ে যায়। এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে তাদের ক্ষেত্রে যারা প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হলেন। এটি মফস্বল শহরের কথা বললাম। গ্রামের কথা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেলাম; কারণ সে দুর্দশা লেখকের পক্ষে অবর্ণনীয়।
    হার্ট অ্যাটাক হলে নিলয় অনিয়মিতভাবে কাঁপতে থাকে। এর ফলে হৃদযন্ত্র থেকে রক্ত সরবরাহ হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে হৃৎস্পন্দন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা সামাল দিতে প্রয়োজন হয় বিশেষ পদ্ধতি। ইনটেনসিভ করোনারি কেয়ার ইউনিট সংক্ষেপে ‘ইকু’ (Intensive Coronary Care Unit; ICCU) এই কাজের জন্য, এক আধুনিক ব্যবস্থা। এখন এ দেশের বড়ো বড়ো শহরের হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে ‘ইকু’ চালু হয়ে গেছে। ‘ইকু’তে থাকে বহু ধরনের জটিল যন্ত্রপাতি ও জীবনদায়ী ওষুধ। হৃৎপিন্ডের অবস্থা ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণের জন্য থাকে ইলেকট্রোকার্ডিও মনিটারিং ওসিলোস্কোপ (Monitoring Oscilloscope)। টিভির মতো এই যন্ত্রের পর্দায় রোগীর ই.সি.জি. অবিরাম আঁকাবাঁকা রেখায় চলতে থাকে। এর সঙ্গে থাকে অডিওভিসুয়্যাল অ্যার্লাম, রোগীর হৃৎস্পন্দন অতি মাত্রায় অনিয়মিত হলে বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটলেই কর্তব্যরত নার্স ও ডাক্তারকে তা সর্তক করে দেয়। রক্তচাপ মাপার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র রক্তচাপ বাড়া বা কমার হদিস দেয়। প্রয়োজন বোধে চালানো হয় কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র। যে সব রোগীর ইলেকট্রিক্যাল হার্ট ব্লক হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে লাগানো হয় টেম্পোরারি পেসমেকার। ক্লোজসার্কিট টিভির সাহায্যে নার্স ও ডাক্তার ডিউটিরুমে বসে একই সঙ্গে একাধিক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

    হৃদয়ের সংকোচন-প্রসারণ অনিয়মিত হলে তাকে বলে অ্যারিদ্মিয়া (Arrhythmia)| । হার্ট অ্যাটাকের রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা প্রথমে হৃৎস্পন্দন নিয়মিত করার ওষুধ (Anti Arrhythemic drug)  প্রয়োগ করেন। আসলে হৃৎস্পন্দনের হার ঠিক থাকলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা কমে যায়।
    কোন রোগীর জন্য ‘ইকু’ প্রয়োজন তা অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন। হার্ট অ্যাটাকে প্রায় ৮৫ শতাংশের মৃত্যু হয় অ্যাটাকের প্রথম ৫ দিনের মধ্যে। তাই সাধারণভাবে হার্ট অ্যাটাকের পর রোগীকে ৫ দিন ‘ইকু’তে রাখা হয়। দরজায় কড়া নাড়তে থাকা যমরাজের মোকাবিলা করার জন্য সফিস্টিকেটেড ইনস্ট্রুমেন্টস ও ওষুধই যথেষ্ট নয়। দরকার ডাক্তার ও নার্সের সম্মিলিত প্রয়াস, গভীর আত্মপ্রত্যয় আর মৃত্যুকে রুখে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প। রাত-বিরাতে ডাক্তারের দেখা না পাওয়া গেলে অভিজ্ঞ নার্সও অনেক সময় রোগীর জীবন বাঁচায়। একটি অপ্রিয় কথা, কাক হয়ে কাকের মাংস খেয়েই বলছি- অনেক সময় রোগীর অবস্থা তেমন খারাপ না হলেও কিছু কিছু বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান রোগীকে প্রথমেই ‘ইকু’-তে ঢুকিয়ে দেন। রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে এরা যতটা না আন্তরিক তার চেয়েও বেশি তৎপর রোগী ও তার পরিবারের থেকে বেশি পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতে। এদের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার সময় এসেছে।
    হার্ট অ্যাটাক হওয়া ও ‘ইকু’তে পৌঁছানোর মধ্যে কিছু সময় নষ্ট হয়ে যায়। এই অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে চালু হয়েছে মোবাইল করোনারি কেয়ার ইউনিট। এটি ‘ইকু’র ছোট সংস্করণ। অ্যাম্বুলেন্সের মতো এই গাড়িতে থাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, জীবনদায়ী ওষুধ ও যন্ত্রপাতি। হাসপাতাল বা ‘ইকু’তে পৌঁছানোর আগেই মোবাইল করোনারি কেয়ার ইউনিটে শুরু হয়ে যায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।
 
এ দেশে বড় বড় নগরগুলির নামী দামী হাসপাতালে শুরু করেছে এক অভিনব পদ্ধতি। এই ব্যবস্থায় আপনি ঘরে বসেই আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। মোটা টাকার বিনিময়ে হৃদ্রোগীকে দেওয়া হয় একটি ছোট পকেট রেডিওর মতো যন্ত্র ‘কার্ডিও বিপারস’(Cardio Beepers)। বিপারটি বুকে লাগিয়ে টেলিফোন লাইন মারফৎ রোগীর হৃদয়ের খোঁজখবর পৌঁছে দেওয়া যায় নির্দিষ্ট হার্ট সেন্টারে। সেখানেই কমপিউটার টার্মিনালে ফুটে উঠবে রোগীর ই.সি.জি.। তাই দেখে অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা টেলিফোন মারফৎ আপনাকে জানিয়ে দেবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ। প্রয়োজন মনে করলে মোবাইল করোনারি কেয়ার ইউনিট রোগীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। এই যুগান্তকারী পরিষেবা ২৪ ঘন্টাই চালু থাকে।
    দুর্দমনীয় মৃত্যুকে রুখে দেবার জন্য চলছে বিজ্ঞানীদের চিরন্তন প্রয়াস। ‘ইকু’ বা মোবাইল করোনারি কেয়ার ইউনিট বহুক্ষেত্রে মৃত্যুর করাল থাবা থেকে ছিনিয়ে আনছে মুমূর্ষু হৃদ্রোগীকে। তবে হ্যাঁ, নগরের সীমাবদ্ধ ভূগোল ছাপিয়ে এ প্রযুক্তি ছাড়িয়ে দিতে হবে গ্রাম-গ্রামান্তরে। যা, আমাদের টেপির মা আর ঐ  খ্যেঁদামিস্ত্রির বিষাদ কালো চোখে এনে দেবে জীবনের ঝিলিক।

Join our mailing list Never miss an update