হৃদয়ের কথা পর্ব-১৮; হৃদরোগীর ডায়াবেটিস

হৃদয়ের কথা পর্ব-১৮; হৃদরোগীর ডায়াবেটিস

হৃদরোগীর ডায়াবেটিস; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৯; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    ইংরেজিতে একটি কথা আছে-Unfortune never comes alone। দুর্ভাগ্য কখনো একলা আসে না। কিছু অসুখের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। শরীরের একটি অঙ্গ বা যন্ত্রে রোগ বাসা বাঁধলে পরবর্তীকালে তা ছড়িয়ে পড়ে দেহের বিভিন্ন অংশে।
    ডায়াবিটিস হলো এমনই একটি ব্যাধি যা থেকে বহু ধরনের উৎপাত দেখা দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে ডায়াবিটিসকে বলা হয় অন্তঃক্ষরা ও বিপাকীয় ত্রুটিজনিত রোগ (Endocrin And Metabolic Disorder)  ।
    আমরা মুখ দিয়ে খাবার খাই। তারপর সেই খাদ্য গ্রাসনালী-পাকস্থলী-অন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পরিপাক বা সরল জৈব যৌগে পরিণত হয়। এই পরিপাক হওয়া খাদ্য অন্ত্র থেকে ভিলাই নামক পর্দার মধ্য দিয়ে রক্তে মেশে। রক্তের মাধ্যমে খাদ্য পৌঁছে যায় বিভিন্ন কোষে কোষে। এরপর হয় বিপাক অর্থাৎ সরল খাদ্যকণার ভেতরে থাকা স্থিতিশক্তিকে অক্সিজেনের সাহায্যে প্রয়োজন মতো ভেঙে শরীর তাপ বা গতিশক্তি লাভ করে।
    ডায়াবিটিস মেলিটাস হলে আমাদের দেহ গ্লুকোজ বা শর্করা থেকে ঠিকমতো তাপ বা গতিশক্তি পায় না। তাই এই রোগে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। দেখা দেয় বিভিন্ন রকমের উপসর্গ। ডায়াবিটিস ইনসিপিডাস (Diabetes Insipidus) বলে আরো এক অসুখ আছে। সেক্ষেত্রে রক্ত বা প্রস্রাবে গ্লুকোজের পরিবর্তে অ্যালবুমিন, ইউরেটস, অকজ্যালেট, ফসফেট থাকে। এখানে ডায়াবিটিস ইনসিপিডাস প্রাসঙ্গিক নয়, তাই এখানে আলোচনা করা হলো না। ডায়াবিটিস বলতে মেলিটাসকেই বোঝানো হয়েছে। ডায়াবিটিস মেলিটাসকে বাংলায় মধুমেহ বলা হয়। অনেকে একে বহুমূত্র বলেন। তবে এটা ঠিক নয় কারণ ডায়াবিটিস মেলিটাস ছাড়াও আরও কিছু রোগে বহুবার মূত্র ত্যাগের প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
    বর্তমানে চিকিৎসকেরা ডায়াবিটিস মেলিটাসকে দু’ভাগে ভাগ করেন-    ১) ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবিটিস মেলিটাস, (২) ইনসুলেন অনির্ভরশীল ডায়াবিটিস মেলিটাস। এই শ্রেণিবিভাগ বোঝার জন্য ইনসুলিনের বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা নেওয়া দরকার। আমাদের পেটের ভেতরে থাকা পৌস্টিকনালীর সঙ্গে যুক্ত আছে অগ্ন্যাশয় বা প্যাংক্রিয়াস। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাদ্য পরিপাকের জন্য অগ্ন্যাশয়ে কয়েকটি উৎসেচক উৎপন্ন হয়। প্যাংক্রিয়াসের নালী যকৃতের পিত্তনালীর সঙ্গে মিশে ক্ষুদ্রান্তের ডিওডিনাম অংশে প্রবেশ করে। ফলে পিত্তরস ও অগ্ন্যাশয়ের রস একসঙ্গে ডিওডিনাম বা গ্রহণীতে এসে পড়ে। প্যাংক্রিয়াসের মধ্যে থাকা ‘আয়লেটস অব্ ল্যাংগারহান্স’- এর বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। বিজ্ঞানী পল্ ল্যাংগারহান্স অগ্ন্যাশয়গ্রন্থিকে কেটে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করার সময় এই দ্বীপের মতো কোষগুলিকে প্রথম শনাক্ত করেন; তাই এমন নাম।
    ইনসুলিন রক্তের ভিতরে থাকা গ্লুকোজকে বিভিন্ন কোষে কোষে যেতে সাহায্য করে। অর্থাৎ দেহে ইনসুলিনের অভাব হলে রক্তে প্রচুর গ্লুকোজ থাকলেও তা কোষ প্রাচীর ভেদ করে ভেতরে পৌঁছাতে পারে না। কোষের মধ্যে থাকা গ্লুকোজ বিভিন্ন পর্যায়ে বা ধাপে ধাপে ভেঙে দেহে শক্তি যোগায়। এই প্রক্রিয়াকে বলে গ্লাইকোলিসিস (Glycolysis)। ইনসুলিন গ্লাইকোলিসিসে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।
    যাদের রক্তে  ইনসুলিন কম থাকে বা একেবারেই থাকে না তাদের স্বাভাবিকভাবে যে ডায়াবিটিস দেখা যায়, তাকে বলে ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবিটিস মেলিটাস (Insulin dependent diabetes mellitus সংক্ষেপে IDDM) এই ধরনের ডায়াবিটিস সাধারণভাবে ৪০ বছর বয়সের আগেই দেখা যায়।
   আগে মনে করা হতো প্রয়োজন মতো ইনসুলিন উৎপাদনের অক্ষমতাই ডায়াবিটিস রোগের একমাত্র কারণ। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখা গেছে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন সঠিক পরিমাণে নিঃসৃত হলেও সেই ইনসুলিন বিভিন্ন কারণে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে দেখা দেয় আর এক ধরনের ডায়াবেটিস। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ইনসুলিন অনির্ভরশীল ডায়াবেটিস মেলিটাস (Non-insulin dependent diabetes mellitus সংক্ষেপে NIDDM) । এই ধরনের ব্যাধি সাধারণভাবে ৪০ বছর বয়সের পরেই হয়ে থাকে। ডায়াবিটিস রোগের লক্ষণ, তীব্রতা, প্রবণতা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এসব কিছুর ওপর বিচার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ডায়াবিটিসকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন-
    ১) ডায়াবিটিস প্রবণতা (Pre-Diabetic State)-  এখন নেই কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে তাকে প্রি-ডায়াবিটিক অবস্থা বলে। দেখা গেছে যমজ ভাই বা বোনের একজনের ডায়াবিটিস থাকলে অপর জনের সেই প্রবণতা থাকে। মা-বাবা দু’জনের এই রোগ থাকলে অথবা বাবা-মা যে কোন একজনের এবং অপর কোনো নিকট আত্মীয়ের এ রোগ থাকলে সেক্ষেত্রে মধুমেহে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
    ২) প্রচ্ছন্ন ডায়াবিটিস (Latent Diabetes)- অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বাভাবিকভাবে সুস্থ থাকলেও বিশেষ বিশেষ শারীরিক অসুবিধার সময় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। একে বলে প্রচ্ছন্ন ডায়াবিটিস। কিছুদিন ধরে অত্যন্ত মানসিক চাপ, অনিদ্রা, দেহে জীবাণুর সংক্রমণ, বড়ো ধরনের সার্জিক্যাল অপারেশনের পর, কোন কোন মহিলার গর্ভবতী অবস্থায় মধুমেহ দেখা দেয়। এই ধরনের ডায়াবিটিস শারীরিক ও মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেলে ধীরে ধীরে কমে আসে।
    ৩) উপদ্রবহীন ডায়াবিটিস (Chemical Diabetes)-  কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, কিন্তু ডায়াবিটিসের কোন রকম উপসর্গ যেমন-রাতে বার বার প্রস্রাব, পিপাসা, দুর্বলতা এসব কিছুই থাকে না। এ রোগকে ডাক্তারবাবুরা বলেন কেমিক্যাল ডায়াবেটিস।
    ৪) আনুষঙ্গিক ডায়াবিটিস (Sencondary Diabetes)-  অন্য কোন অসুখের উপসর্গ হিসাবে কখনো কখনো ডায়াবিটিস দেখা যায়। অগ্ন্যাশয়ের রোগ, দীর্ঘদিন কোন ওষুধ ব্যবহারের কুফল, লিভারের গোলযোগ এসব কারণে সেকেন্ডারি ডায়াবিটিস হতে পারে।
    ৫) প্রকট ডায়াবিটিস (Clinical Diabetes)- এ ধরনের ডায়াবিটিসে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়। বার বার পিপাসা, তাড়াতাড়ি খিদে পাওয়া, দিনে রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব, ওজন কমে যাওয়া, দুর্বলতা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, চোখে ছানি পড়া, কার্বাঙ্কল ও কাটা দাগ সহজে শুকোতে না চাওয়া-এ রকম আরো বহু অসুবিধা দেখা দেয়। ডায়াবিটিস বলতে মূলত ক্লিনিক্যাল ডায়াবিটিসকেই বোঝায়। এ রোগের চিকিৎসা প্রথম থেকেই সঠিকভাবে করতে হবে। খাদ্য, ব্যায়াম, ওষুধ খাওয়া এসব বিষয়ে মেনে চলতে হবে চিকিৎসকের নির্দেশ।

    এ রোগে ইনসুলিনের অভাবে রক্তের গ্লুকোজ ভেঙে শক্তি পাওয়া যায় না। তাই দেহ প্রথমে চর্বি বা ফ্যাট থেকে ও পরবর্তী সময়ে প্রোটিন বিশ্লিষ্ট করে প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে। বেশি পরিমাণে চর্বি বিশ্লিষ্ট হওয়ার ফলে নানা রকমের উপজাত বস্তু তৈরি হয়। যেমন-ফ্যাটি অ্যাসিড, বিটা হাইড্রোক্সি বিউটিরিক অ্যাসিড, অ্যাসিটোন এসব রক্তের মধ্যে জমতে থাকে। এর মধ্যে কিছু কিছু অবশ্য মূত্রের মধ্য দিয়ে দেহের বাইরে বেরিয়ে যায়। রক্তে বেশি পরিমাণ ফ্যাট জাতীয় পদার্থ থাকার ফলে ধমনীর ভেতরের দেওয়াল খসখসে হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ধমনীর ভেতর চর্বিকণা জমে রক্ত চলাচলের পথ সরু করে দেয়। হৃদযন্ত্রের রক্ত সরবরাহকারী করোনারি ধমনী সরু হয়ে গেলে দেখা দেয় হৃৎপেশিতে পুষ্টি ও অক্সিজেনের অভাব। এ থেকেই শুরু হয় নানা গোলমাল। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়, বমি-বমি ভাব আরও কত কী। এসব উপসর্গ থেকেই করোনারি থ্রম্বোসিস বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
    ডায়াবিটিস হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৬২ জন কোনো না কোনো ডায়াবিটিস রোগে আক্রান্ত।
    ডায়াবিটিস থাকলে বা রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি হলে স্নায়ু (Nerve)র কাজকর্ম বাধাপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা যন্ত্রে দেখা দেয় অসাড়তা। এর ফলে ব্যথা, স্পর্শ, তাপ প্রভৃতি ঠিকমতো বোঝা যায় না। হার্ট অ্যাটাকের আগাম লক্ষণ হলো বুকে ও বাঁ-হাতে ব্যথা, যাকে বলে অ্যানজাইনা পেক্টোরিস।  ডায়াবিটিসে যেহেতু অ্যাথেরোসক্লেরোসিস বা ধমনী বুজে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে তাই মস্তিষ্কের ধমনীতে রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে অনিদ্রা, একাগ্রতার অভাব, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হাত-পায়ে দুর্বলতা আরো কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
    
হৃদযন্ত্রের ডান অলিন্দে আছে একটি ছোট্ট অঞ্চল। যার নাম সাইনো অরিকুলার নোড (S.A.Node)। এখান থেকেই নির্দিষ্ট ছন্দের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সমস্ত অলিন্দ ও নিলয়ে ছড়িয়ে পড়ে ও সংকোচন প্রসারণ ঘটায়। ডায়াবিটিসের ফলে অনেক ক্ষেত্রে সাইনো অরিকুলার নোড থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত সময় মতো হৃৎপেশির সব অংশে পৌঁছাতে পারে না। ফলে হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুত, খুব ধীর বা অনিয়মিত হতে থাকে। এভাবেই হার্ট ব্লক হতে পারে।
    ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করে বিপদ এড়াতে পারে। ডায়াবিটিসের কারণে অনেক সময় অ্যানজাইনা রোগী বুঝতে পারে না। ফলে কোন উপসর্গ ছাড়াই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। দেখা গেছে যে, সব রোগীর মধুমেহ আছে, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকে পক্ষাঘাত বা প্যারালিসিসের শিকার হন।
    আমাদের কিডনির মধ্যে ছোট ছোট ছাঁকনি আছে। এই ছাঁকনির মাধ্যমে রক্ত পরিস্রূত হয়ে মূত্র তৈরি হয়। এই ছাঁকনিকে বলে গ্লোমেরুলাস (Glomerulus)। মধুমেহ-এর কারণে গ্লোমেরুলাসের ভেতরে থাকা ছোটো ছোটো রক্তনালীগুলিতে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হয়ে ধীরে ধীরে বুজে যায়। এর ফলে যে রোগ দেখা যায় তাকে বলে নেফ্রোপ্যাথি (Nephropathy)। নেফ্রোপ্যাথির অন্যতম লক্ষণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। যা পরবর্তী কালে হৃদরোগের কারণ।
আপনার ডায়াবেটিস আছে কি না? তা বোঝার জন্য একটি সহজ পদ্ধতি জেনে নিন। চিত্রের মধ্যে থাকা প্রশ্নগুলির উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে ছবির সংখ্যাগুলি যোগ করুন। যদি আপনার ক্ষেত্রে সংখ্যাগুলির যোগফল সাত (৭) বা তার বেশি হয় তবে রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা (Blood Sugar Post Pondia)  করান।

ডায়াবিটিসকে পুরোপুরি দুর করার কোন চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। তবে চিকিৎসকের নির্দেশমতো চললে ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। যেমন-
    ১) শক্তিক্ষয় ও খাদ্যের শক্তিমূল্যের মধ্যে সমতা রক্ষা: দেহের সুস্থ, সবল ও কর্মঠ রাখার প্রয়োজনীয় শক্তি আমরা খাদ্য থেকে পাই। দেহের ওজন, বয়স ও কী কী ধরনের কাজ কতক্ষণ ধরে করতে হয় তার ওপর নির্ভর করে দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণ বা ক্যালোরি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করলে তা মধুমেহ রোগের কারণ হতে পারে। মোটামুটিভাবে বলা যায়- যারা পেশাগতভাবে শারীরিক পরিশ্রম করেন যেমন-কৃষক, মজুর, মুটে, রিক্সা চালক; তাদের প্রতি কেজি দেহের ওজনের জন্য দৈনিক ২০-২২ ক্যালোরি খাদ্য প্রয়োজন। অর্থাৎ কোনো রিক্সাওয়ালার নিজস্ব ওজন যদি ৫৫ কেজি হয় তবে তার প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণ হবে দৈনিক (৫৫ X ২২)= ১২১০ ক্যালোরি। কেরানি বা ঐ ধরনের কাজ যাদের করতে হয় তাদের ক্ষেত্রে এটি হবে প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য দৈনিক ১০ থেকে ১৩ ক্যালোরি। বুদ্ধিজীবি বা যাদের শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না, তাদের প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য ৬ থেকে ৭ ক্যালোরি। এছাড়াও যৌবনে-কৈশোরের বাড়ন্ত বয়সে, মহিলাদের গর্ভধারণ ও সন্তান পালনের সময় অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজন হয়।
    ২) পথ্যের উপাদানের সঠিক অনুপাত: আমাদের খাদ্যের মূল উপাদান হলো-কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট। চাল, আটা, সুজি, মুড়ি, চিড়া, ময়দা, সাবু, আলু, গুড়, চিনি-এসব হলো কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য। অনেক চিকিৎসকের  মতে ডায়াবিটিস রোগীর ক্ষেত্রে মোট ক্যালোরির ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পূরণ করতে হবে কার্বোহাইড্রেট দিয়ে। বাকি ৬৫ থেকে ৬০ শতাংশ শক্তি নিতে হবে প্রোটিন ও ফ্যাট থেকে। কিন্তু রোগীর যদি ডায়াবিটিসের সঙ্গে হার্টের অসুখ থাকে, তবে বেশি পরিমাণ প্রোটিন ও ফ্যাট থেকে সংগৃহীত শক্তির অনুপাত হবে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। বাকি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ক্যালোরির মধ্যে প্রোটিন হবে বোশি আর ফ্যাট হবে খুব সামান্য। মাছ, মাংস, ডিম, ছানা প্রোটিন জাতীয় খাদ্য। দেহগঠন ও খাদ্যের রুচি বাড়ানোর জন্য প্রাণীজ প্রোটিন প্রয়োজন। তবে যাদের হৃদরোগ ও ডায়াবিটিস আছে তাদের প্রাণীজ প্রোটিন বেশি না খাওয়াই ভালো। সয়াবিন, চিনাবাদাম, কাজুবাদাম, বিভিন্ন রকমের ডাল এসব খাওয়া যেতে পারে। তাতে গ্লুকোজের সঙ্গে কোলেস্টেরলও স্বাভাবিক থাকবে। মাংস খেতে হলে সবসময় মুরগি বা ছোট পাখির মাংস খাবেন। পাঁঠা, খাসি, গরু, শুকরের মাংস খাবেন না। বাগদা বা গলদা চিংড়ি, মেটে এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়।
    চর্বি, তেল, ঘি প্রভৃতি খাদ্যই ফ্যাটের অন্যতম ভান্ডার। ডায়াবিটিস ও হার্টের রোগ একসঙ্গে থাকলে ফ্যাট যতটা সম্ভব কম খাওয়াই উচিত। বিশেষত যারা একটু মোটাসোটা। যে সব তেলে অসংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ((Unsaturated Fatty Acid)  বেশি আছে, যেমন-সূর্যমুখী তেল, সয়াবিন তেল, ভুট্টার তেলে রোগীর খাবার রান্না করতে হবে। বর্তমানে বাজারে বহু ধরনের ননস্টিক ফ্রাইপ্যান পাওয়া যায়। যাতে কম তেলে রান্না বান্না হয়।
    ৩) বিভিন্ন আহারে ক্যালোরি বন্টন: সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালিরা দিনে চারবার খাবার খায়। এর মধ্যে দুপুর ও রাতে দু’বার বেশি করে খাওয়া এবং সকাল ও বিকালে টিফিন। এছাড়া মাঝেমধ্যে চা-বিস্কুট বা লৌকিকতার খাতিরে অন্যকিছু খেতে হয়। দৈনিক যত ক্যালোরি খাদ্য আপনার প্রয়োজন তার ২১ শতাংশ খাবেন সকালের ব্রেকফাস্টে বা প্রাতঃরাশে, মধ্যাহ্ন ভোজনে ৩৬ শতাংশ, বিকালের টিফিনে ১৪ শতাংশ, রাতের খাবারে ২৫ শতাংশ ও অবশিষ্ট ৪ শতাংশ অন্যভাবে খাবেন। এ হিসাব আপনার ব্যক্তিগত রুচি, কাজের সময় ও পারিবারিক অবস্থা অনুসারে কিছুটা অদল-বদল করতে পারেন। তবে ডায়াবিটিস ও হৃদরোগীদের রাতের বেলায় বেশি ভারি কিছু খাওয়া ঠিক নয়।
    ৪) নিয়মিত ব্যায়াম: হার্ট ডিজিজ্ ও ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যায়ামের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। নিয়মিত ব্যায়াম কার্বোহাইড্রেট বিপাকে সাহায্য করে। বিশেষত যারা একটু মোটাসোটা-গোলগাল তাদের অবশ্যই ব্যায়াম করতে হবে। বয়স, রোগের তীব্রতা, রোগীর ওজন, রক্তচাপ অনুসারে ব্যায়াম বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন- হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা আরো কিছু। প্রতিদিন অন্তত ২৫ থেকে ৩০ মিনিট এ বিষয়ে বরাদ্দ করতে হবে।
    ৫) রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা: ১২ ঘন্টা অনশনের পর রক্তে শর্করার মাত্রা যদি প্রতি ১০০ মিলিমিটারের ১২০ মিলিগ্রামের বেশি থাকে বা কিছু পরিমাণ গ্লুকোজ খাওয়ার দু’ঘন্টা পর প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ১৮০ মি.গ্রা.-এর বেশি হলে তা ডায়াবিটিস বলে ধরা হয়। সঠিক খাদ্যগ্রহণ, ব্যয়াম এসবের পরেও অনেক সময় দেখা যায় রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকে। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ খেতে বা প্রয়োজনে ইনজেকশন নিতে হয়। ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে যে সব ওষুধ সাধারণত অ্যালোপ্যাথিক মতে ব্যবহৃত হয় তাদের দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়-সালফোনিলয়ুরিয়া ও বাইগুয়ানাইড।
    সালফোনিলয়ুরিয়া শ্রেণিতে রয়েছে বিভিন্ন ওষুধ যেমন-গ্লাইপিজাইড, টলবুট্যামাইড, ক্লোরপ্রোপ্যামাইড, গ্লাইবেনক্লেমাইড। এগুলি ডেওনিল, গ্লাইনেস, ডায়াবিনিজ, রাস্টিনন প্রভৃতি বাজারি নামে পাওয়া যায়।
    বাইগুয়ানাইড শ্রেনিতে রয়েছে-ফেন-ফর্মিন, মেট-ফর্মিন এগুলি বাজারে পাওয়া যায় ডিবিআই, গ্লাইসিফেজ নামে। এই ওষুধগুলো বিভিন্ন ভাবে কাজ করে। কোনো ওষুধ প্যাংক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, পৌষ্টিকনালী থেকে গ্লুকোজ অবশোষণ কমিয়ে দেয়, কোনো ওষুধ যকৃতের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম রাখে, কেউ বা আবার পেশিতে গ্লুকোজ বিয়োজন ও বিপাক বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তারবাবুরা আপনাকে পরীক্ষা করার পর চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করেন আপনার জন্য কোন ওষুধটা, কী মাত্রায় দরকার। এ বিষয়ে নিজে কোনো মাতব্বরি করতে যাবেন না; তাতে মারাত্মক বিপদ হতে পারে।
    ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে হোমিয়োপ্যাথিতেও অনেক ওষুধ আছে। লক্ষণ অনুসারে প্রয়োগ করলে অ্যাসিড ফস্ফরিকাম (Acid Phosphoricum), ইউরেনিয়াম নাইট্রিকাম (Uranium Nitricum), সিজিজিয়াম জ্যাম্বোলেনাম (Syzygium Jambolanum) প্রভৃতি ভালো ফল দেয়। বায়োকেমিক মতে- নেট্রামসালফ  (Natrum Sulph), নেট্রাম ফস  (Natrum Phos), নেট্রাম মিউর (Natrum Mur) এ কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশেষত যাদের ডায়াবিটিসের সঙ্গে অম্বলের দোষ আছে তাদের ক্ষেত্রে নেট্রামফস খুবই কার্যকারী। অনেক সময় এত সব ওষুধেও মধুমেহ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তখন ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন ইনজেকশন বিভিন্ন রকমের। ইনজেকশন নেওয়ার পর ক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় ও কতক্ষণ এটি ক্রিয়াশীল থাকে তার ওপরে ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-স্বল্পমেয়াদী বা সল্যুবল ইনসুলিন  (Soluble Insulin), নাতিদীর্ঘ ক্রিয়াশীল বা সেমি লেংদি ইনসুলিন (Semi lengthy Inuslin), দীর্ঘ ক্রিয়াশীল বা আলট্রা লেংদি ইনসুলিন, আরো কয়েক প্রকার ।
    আর একটি বিষয় একটু খোলসা করা উচিত। অনেকের একটা ধারণা আছে যে, ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে একবার ইনসুলিন ইনজেকশন নিলে আর রক্ষে নেই। ভবিষ্যতে নিয়মিত ইনজেকশন নিতে হবে। কোনো খাওয়ার ওষুধে কাজ হবে না। এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকে প্রয়োজনের সময় ইনজেকশন না নিয়ে ট্যাবলেট খেয়ে বিপত্তি ডেকে আনেন। ইনসুলিনের প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই নিতে হবে। এর জন্য সারা জীবন এর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে; এটা ঠিক নয়।
    ডায়াবিটিস ও বংশগতি- বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে ডায়াবিটিস রোগে বংশগত প্রভাব বেশ ভালো ভাবেই রয়েছে। মা অথবা বাবা যে কোন একজনের ডায়াবিটিস থাকলে সন্তানের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ২২ শতাংশ। আর যদি দু’জনেরই থাকে তবে সে ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেড়ে হয় ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ।
    মা অথবা বাবা যে কোনো একজনের এবং অন্য কোনো রক্তের সম্পর্কযুক্ত নিকট আত্মীয়ের এ রোগ থাকলে সেক্ষেত্রে ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। কাকা বা মামার ডায়াবিটিস থাকলে ভাগ্নে-ভাগ্নী বা ভাইপো-ভাইঝির এ রোগের সম্ভাবনা ৬ থেকে ৮ শতাংশ। যমজ সন্তানের মধ্যে ডায়াবিটিসের বংশগত প্রভাব প্রবল ভাবেই দেখা যায়। হুবহু যমজ বা ইউনিওভ্যুলার ট্যুইন (Uniovular twin) এর ক্ষেত্রে একজনের ডায়াবিটিস থাকলে অপরের এ রোগের প্রবণতা ৫০ শতাংশ। আর ভিন্ন যমজ বা বাইওভ্যুলার ট্যুইন (Biovular twin) এর ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২২ শতাংশ।
    এটা ঠিক যে, বংশগত প্রবণতা থাকলেও যদি যৌবনের প্রথম থেকেই খাদ্য, ব্যায়াম, দেহের ওজন এসব বিষয়ে সঠিক নজর দেওয়া যায় তবে বংশগত ডায়াবিটিস এড়ানো সম্ভব। এ প্রসঙ্গে একটি মজার কথা মনে পড়ে গেল- এক ডায়াবিটিস রোগীকে পরীক্ষা করার পর বলেছিলাম তার অসুখটি বংশগত। তিনি বলেছিলেন-‘তবে আমার মেডিকেল বিলটা আমার ঠাকুরদাকে পাঠিয়ে দিন!’   

Join our mailing list Never miss an update