হৃদয়ের কথা পর্ব-১০; হৃদয়ের বাতরোগ

হৃদয়ের কথা পর্ব-১০; হৃদয়ের বাতরোগ

হৃদয়ের বাতরোগ; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ৬ই অক্টোবর ১৯৯৭ দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
তেমনই ডাগর কালো চোখ, তেমনি একরাশ বাবরি চুল। আমি ওর নাম দিয়েছি নজরুল। নজরুলের বাবা হাতিম আনসারি রাজমিস্ত্রির জোগালি। মা মালতি খাতুন পাঁচবাড়ির ঠিকা ঝি। রেল লাইনে পাশে গড়ে ওঠা হঠাৎ কলোনিতে ওদের আস্তানা। শৈশবে নজরুল কিভাবে হেঁটে খেলে বেড়াত -তা আমি দু’চোখ বন্ধ করে বেশ দেখতে পাই। গত দশমাস সে পুরোপুরি শয্যাশায়ী।
    প্রথমদিকে প্রায়ই সর্দি-কাশি, হাত-পা ব্যথা এসব লেগে থাকতো। তারপর গাঁটগুলি ফুলে যায়। মালতি পাড়ার দোকান থেকে এনেছিল পাইরোজেসিক-অ্যানালজেসিক ট্যাবলেট। বাবুর বাড়ির টিভি দেখে লাগিয়েছিল ‘সর্দি, শিরদর্দ, পীড়াকো পলমে দূর করা বাম।’ আমার কাছে যখন এল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রোগ হাত-পা’র সঙ্গে বাসা বেঁধেছে হৃদয়ে।
    চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ্ (Rheumatic Heart Disease)। সহজে বাংলা করে হৃদয়ের বাতরোগ বলা যেতে পারে। বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস (Beta Hemolytic Strepto Coctus) নামের জীবাণুই এর জন্য মূলত দায়ী। স্ট্রেপটোকক্কাস নাম থেকেই বোঝা যায় এরা দেখতে কেমন (স্ট্রেপটো: সোজা; কক্কাস: গোলাকার)। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ব্যাকটেরিয়াগুলি দেখতে গোল গোল পুঁতি দিয়ে গাঁথা লম্বা মালার মতো।
    প্রথমদিকে প্রায়ই সর্দি, কাশি, জ্বর, গলাব্যথা, টনসিলাইটস বা ফ্যারিনজাইটিস দেখা । সে সময় কফ পরীক্ষা করলে গ্রুপ-এ; বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস পাওয়া যেতে পারে। ভারতবর্ষের মতো গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলিতে ৭-১৫ বছরের ছেলেমেয়েরাই সাধারণত এ রোগের শিকার। এই অসুখ প্রথম দিকে একনাগাড়ে থাকে না। কিছুদিন কষ্ট হয় আবার কিছুদিন রোগী বেশ ভালো থাকে।
    এই রোগ জীবাণু গলা-টনসিল, হাত-পা’র গাঁটে আক্রমণ করলেও মূল আঘাত হানে হৃদযন্ত্রে। ডাক্তারিমহলে এ নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে- 'It licks the joint but bites the heart' - এ গাঁটগুলি চেটে যায়, কিন্তু হৃদয়ে কামড় বসায়।
 
   এ রোগের আক্রমণে সাধারণত হাঁটু, গোঁড়ালি, কনুই, কাঁধ এসব বড়ো বড়ো সন্ধিগুলি ফুলে ওঠে ও ব্যথা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, এক গাঁট ভালো হয়ে অন্য এক সন্ধি আক্রান্ত হয়। একে ফ্লিটিং বা মাইগ্রেটারি আর্থাইটিস (Flitting or Migratory Arthritis)  বলে। এই অসুখে যখন জ্বর চলতে থাকে, তখন খুব ঘাম হয়। জ্বরের তুলনায় হৃৎস্পন্দনের হার বেশি থাকে। শিশুর কাছাকাছি অপরিচিত কেউ এলেই সে কাঁদতে শুরু করে। কোনো কোনো রোগীর চামড়ার নিচে মটরদানার মতো ছোটো ছোটো টিউমার দেখা দেয়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলি রিউম্যাটিক নডিউল (Rheumatic Nodule)। বাতরোগে আক্রান্ত ১৫-২০ শতাংশ শিশুদের গায়ে ফিকে লাল রঙের দাগ দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এই দাগ সাপের মতো আঁকা বাঁকা, কখনও বা গোলগোল। একে বলে এরিথিমা মার্জিনেটাম (Erythema Marginatum)। রিউম্যাটিক হার্ট ডিসিজের মূল লক্ষ্য হৃদযন্ত্রের মাইট্রাল ভালভ ও আওর্টিক ভালভ (Aortic Valve)। আমরা জানি, বাম অলিন্দ ও বাম নিলয়ের মাঝে রয়েছে দুই কপাটের দরজা বা মাইট্রাল ভালভ। ফুসফুস থেকে আসা অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বাম নিলয় দিয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। সে কারণে মাইট্রাল ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, যন্ত্র ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। তাই রিউম্যাটিক হার্ট ডিসিজ্ থেকে পরবর্তীকালে কিডনির ব্যথা (Kidney Inflamation), গ্লোমেরিউলো নেফ্রাইটিস (Glomerulo Nephritis), স্কারলেট জ্বর আরও বহু রোগ দেখা যায়।
হৃদয়ের বাতরোগে একবার ভালোভাবে আক্রান্ত হলে এই রোগ কখনই পুরোপুরি সারে না বা সারলেও ভবিষ্যতে কিছুদিন অস্বাস্থ্যকর আচার-আচরণ করলে আবার তা ফিরে আসে। এ রোগ চিকিৎসার জন্য বেনজায়িন পেনিসিলিন (Benzathine Penicilin), প্রিদনিসোলেন (Prednisolone), অ্যাসপিরিন (Aspirin), ফেনক্সিমিথাইল পেনিসিলিন (Phenoxymethyle Penicilin) প্রভৃতি ওষুধ রোগের গভীরতা ও তীব্রতা অনুসারে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করা হয়।

    হোমিওপ্যাথি মতে এই রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে লক্ষণ অনুসারে রাসটক্স (Rhus Tox), ব্রায়োনিয়া (Bryonia), মেডোরিনাম (Meddorrhinum), থুজা (Thuja), এপোসাইনাম (Aposynum), ক্যাকটাস (Cactus G) প্রয়োগ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়।
    রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ যাতে না হয়, সেজন্য প্রথম থেকেই সতর্ক হতে হবে। বারবার গলাব্যথা, জ্বর, কাশি, হাত-পা ব্যথা হলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এদের মধ্যে যাদের টনসিলের অসুখ আছে তাঁদের গলায় সেঁক দেওয়া, মাফলার বাঁধা, উষ্ণ লবণ জলে গার্গল করা ও ই.এন.টি স্পেশালিস্ট দেখানো উচিত। হৃদযন্ত্রের বাতরোগে রক্তের ই.এস.আর         (Erythrocyte Sedimentation Rate : E.S.R.) বেড়ে যায়। সে কারণে রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে কফের সঙ্গে ই.এস.আর. পরীক্ষা করানো দরকার। এছাড়াও সি রিয়েকটিভ প্রোটিন (C Reactive Protein), ই.সি.জি., ইকোকার্ডিওগ্রাম এসব পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
    আমাদের দেশে প্রায় ৭০ লক্ষ শিশু এ রোগের শিকার। ৫ থেকে ১৫ বছরের প্রতি ২০০ জনের একজন শিশু হৃদয়ের বাতরোগে ভুগছে।
    অজ্ঞানতার অন্ধকার, অপুষ্টিকর খাদ্য, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এ রোগের উর্বর জমিন। যোজনার বকম-বকম নয়, নয় কোনো ঝানু স্টাটিস্টিসিয়ানের তৈরি প্রগতির লেখচিত্র। সরকার, পঞ্চায়েত, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রয়াসে আনতে হবে এক সমুজ্জ্বল ভোর। যে সকালে আগামী প্রজন্মের জন্য থাকবে সতেজ নিঃশ্বাসের আশ্বাস। তা না হলে ফুলের জলসায় নীরব রবে আরও কত নজরুল।

 

Join our mailing list Never miss an update