হৃদয়ের কথা পর্ব-৮; হার্ট অ্যাটাক

হৃদয়ের কথা পর্ব-৮; হার্ট অ্যাটাক

হৃদয়ের কথা; পর্ব-৮; হার্ট অ্যাটাক
    বড়ো মেয়ে দীপান্বিতার বিয়ে দিয়ে তারপর অন্য কাজ। সমীরবাবু এখন আর অন্য কিছু ভাবতে রাজী নন। আর ছয় বছর চাকরি আছে। ততদিনে বাবলুর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার কথা। বড়ো ম্যানেজারকে বললে তিনি কথা ফেলতে পারবেন না। তাছাড়া চা-বাগানের এটা একটা অলিখিত নিয়ম।
    না, জগতের সব ঘটনা আশানুরূপ ভাবে ঘটে না। যদিও বিষয়টিকে পুরোপুরি আকস্মিক বললে ভুল হবে। মাঝে মাঝে বুকে একটা ব্যথা হতো। তবে এমনটি হবে তা কে জানতো। হার্ট অ্যাটাক এমন করেই হঠাৎ সব পরিকল্পনা ওলট-পালট করে দেয়। হার্ট অ্যাটাককে ডাক্তারি ভাষায় বলি মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন (Myocardial Infraction)।
    বুকে অসহ্য যন্ত্রণা, মনে হয় বুকটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। ব্যথাটা বুকের মাঝখান থেকে বাঁ-কাঁধে, পিঠে- হাতে, চোয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। কখনো আবার অব্যক্ত অস্বস্তি ও শ্বাসকষ্ট হয়। বুক ধড়ফড় করে। কারো ক্ষেত্রে হৃৎস্পন্দনের হার খুব বেড়ে যায়, কারো বেলায় তা কমে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বমির উপসর্গ দেখা দেয়। প্রথমদিকে ব্লাডপ্রেসার বেড়ে গেলেও পরে তা কমে আসে। এ ধরণের বিভিন্ন লক্ষণ হার্ট অ্যাটাকের সময় দেখা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জনসমীক্ষা করে দেখেছেন কতগুলি বিশেষ কারণের জন্যই হার্ট অ্যাটাক হয়। প্রচলিত কথায় একে বলে রিস্ক ফ্যাক্টর। রিস্ক ফ্যাক্টরগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।
১)    আন কন্ট্রোলেবল রিস্ক ফ্যাক্টর।
২)    কন্ট্রোলেবল মেজর রিস্ক ফ্যাক্টর।
৩)    কন্ট্রোলেবল মাইনর রিস্ক ফ্যাক্টর।

    ১) আন কন্ট্রোলেবল রিস্ক ফ্যাক্টর : এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলির ওপর রোগীর ব্যক্তিগতভাবে কোনো হাত থাকে না। অর্থাৎ এসব তার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। চেষ্টা চরিত্র বা অভ্যাস করে এগুলির অদল-বদল সম্ভব নয়। যেমন-
  (ক) বংশগতি (Heridity) : যদি পরিবারের মধ্যে পঞ্চাশ বছর বয়সের নিচে হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকে সে ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেশি।
  (খ) বয়স (Age)  : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। বেশির ভাগ মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন হয় ৪০ থেকে ৬৫ বছর বয়সের মধ্যে।
   (গ) লিঙ্গ (Sex)  : পুরুষের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বেশি। সমীক্ষা করে জানা গেছে ৪০-৬৫ বছরের পুরুষ ও মহিলার হার্ট অ্যাটাকের অনুপাত ৪:১। ৪০ বছরের নিচে এটি ৮:১। ৭০ বছরের ওপরে পুরুষ ও মহিলার হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা প্রায় সমান সমান।
    ২) কন্ট্রোলেবল মেজর রিস্ক ফ্যাক্টর: এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয়। তবে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সঠিক খাদ্য, ব্যায়াম ও ওষুধের সাহায্যে এগুলিকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা যায়। যেমন-
(ক) উচ্চরক্তচাপ (High blood pressure): উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ।
 (খ) ডায়াবিটিস মেলিটাস (Diabetes Mellitus): ডায়াবেটিস থাকলে মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশনের মাত্রা প্রবলভাবে বাড়ে।
 (গ) হাই ব্লাড কোলেস্টেরল ও ট্রাই গ্লিসারাইড (High blood cholesterol and triglyceride): রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাই গ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি হলে তা করোনারি ধমনীর ভেতরে জমে হৃৎপেশীতে রক্ত সরবরাহের ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে দেখা দেয় হার্ট অ্যাটাক।
 (ঘ) ধূমপান (Smoking): ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের হার্টের অসুখের সম্ভাবনা প্রায় ৬ গুণ বেশি। 
    ৩) কন্ট্রোলেবল মাইনর রিস্ক ফ্যাক্টর: এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি পরোক্ষভাবে হার্ট অ্যাটাককে ত্বরান্বিত করে। তবে বিভিন্নভাবে এগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যেমন-
(ক) ঘুম (Sleeping): ঘুম ঠিকমতো গভীর না হলে হৃদযন্ত্র সঠিক বিশ্রাম পায় না। হৃৎপেশির ওপর এই অতিরিক্ত চাপ হার্ট অ্যাটাকের পরোক্ষ কারণ হতে পারে।
 (খ) মানসিক উত্তেজনা (Mental tension): উদ্বেগ, উচ্চাকাঙক্ষা, রাগ, হিংসা এগুলি দেহের ভেতর থাকা বিভিন্ন হরমোন গ্রন্থিগুলিকে উত্তেজিত করে। যা থেকে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে।
 
   মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হলো- এ রোগের লক্ষণগুলি অন্যসব সাধারণ অসুখের সঙ্গে মিলে যায়। তাই রোগীরা প্রথম দিকে তত গুরুত্ব দেন না। যেমন- বুকে ব্যথা হলে অনেকে বদহজম বা গ্যাস হয়েছে মনে করে অ্যান্টাসিড খান। তার ফলে রোগ যখন মারাত্মক আকার নেয় তখন বিশেষ কিছু করার থাকে না।
সাধারণভাবে হার্ট অ্যাটাকে যতজন মারা যান তার মধ্যে শতকরা আটজনের মৃত্যু ঘটে অ্যাটাকের আধা ঘন্টার মধ্যেই। ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যান শতকরা ৪০ জন।
    মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশনের ক্ষেত্রে যে শারীরিক যন্ত্রণা বা অসুবিধা দেখা দেবেই তা নয়। অনেক সময় কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। পরবর্তী সময়ে ই.সি.জি. করলে তা ধরা পড়ে। একে বলে সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক। বিশেষত ডায়াবিটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন কারণে হৃদ্ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। একে বলে করোনারি থ্রম্বোসিস (Coronary thrombosis)। এর ফলে হৃৎপেশিতে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ হতে পারে না। যার ফলস্বরূপ হয় হার্ট অ্যাটাক।
    হার্ট অ্যাটাক হলে সিস্টোলিক প্রেসার কমে যায়। রোগীর চেহারা হয় বিবর্ণ পান্ডুর। এ সময়ে ঘাড়ের কাছে থাকা জুগুলার ভেনের রক্তচাপ বেড়ে যায়। ডাক্তারবাবুরা যখন স্টেথোস্কোপ দিয়ে এ ধরনের রোগীর বুক পরীক্ষা করেন সে সময় তৃতীয় হৃদধ্বনি (Third Heart Sound) শুনতে পান। প্রথম হৃদধ্বনি অনেকক্ষেত্রে শোনা যায় না। ফুসফুসের স্থানে কেমন চট্পটে শব্দ (Lung crepitation)  শোনা যায়। হৃদযন্ত্রের বাইরের স্তর পেরিকার্ডিয়ামে ঘর্ষণ ধ্বনি (Pericardial Friction)।
         হার্ট অ্যাটাকের রোগীর ক্ষেত্রে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। যাকে আমরা বলি অ্যারিদ্মিয়া (Arrhythmia)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃদু কখনও বা প্রবল। এগুলি আবার বিভিন্ন রকমের যেমন- (১) ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশন (Ventricular Fibrillation), (২) অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (Atrial Fibrillation), (৩) ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া (Ventricular Tachycardia), (৪) অ্যাট্রিয়াল ট্যাকিকার্ডিয়া (Atrial Tachycardia), (৫) হার্ট ব্লক্ (Heart Block), (৬) ভেন্ট্রিকুলার একটোপিক (Ventricular ectopic, (৭) অ্যাক্সেলারেটেড ইডিও ভেন্ট্রিকুলার রিদম (Accelerated idioventricular rhythm)। উন্নতমানের ই.সি.জি-তে এই সব অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ধরা পড়ে।
        হার্ট অ্যাটাকের পর দেখা গেছে রক্তরস বা ব্লাড সিরাম (Blood Serum)-এ কিছু উৎসেচক বা এনজাইমের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই এই  এনজাইমের মাত্রা পরীক্ষা করাই হার্ট অ্যাটাক নিরূপণের অন্যতম হাতিয়ার। এর মধ্যে রয়েছে সিরাম গ্লুট্যামিক অক্সালো অ্যাসোটিক ট্রান্সমিনেজ সংক্ষেপে এস.জি.ও.টি (S.G.O.T), ক্রিঅ্যাটিনিন ফসফোকাইনেজ সংক্ষেপে সি.পি.কে. (C.P.K)। সাধারণভাবে এস.জি.ও.টি-র মাত্রা ২-২০ ইউনিট/মিলি। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ২৪-২৮ ঘন্টার মধ্যে এটি হয়ে যায় ৭০-৫০০ ইউনিট/মিলি। হার্ট অ্যাটাকের চার থেকে সাতদিনের মধ্যে এটি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। সি.পি.কে-এর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে। রক্তের ই.এস.আর. হার্ট অ্যাটাকের পর বেড়ে যায়।
        হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপেশির কিছু অঞ্চল পুষ্টি ও অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। একে বলে নেক্রোসিস (Necrosis)| । নেক্রোসিস হলে রোগীর জ্বর আসে। তবে সব হৃৎপেশি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না। কিছু পেশি হাইবারনেট (Hybernet)  করে। অর্থাৎ শীতকালে সাপ, ব্যাঙের ঘুমের মতো নিস্তেজ হয়ে থাকে। পেশি সম্পূর্ণ মরে যেতে সময় নেয় ৫-৬ দিন। তাই অনেক ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের রোগীর ওপর জরুরিভিত্তিতে বাইপাস সার্জারি করা হয়। যাকে বলে ইমারজেন্সি বাইপাস সার্জারি।
 
     হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করেন। ব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রণা, কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়- মরফিন (Morphine), পেথিডিন (Pethedine), প্রোক্লোরপেরাজিন (Prochlorperazine)  প্রভৃতি। জমাট বাঁধা রক্তকে তরল করতে ব্যবহৃত হয়- স্ট্রেপটোকাইনেজ (Sterptokinase), অলটিপ্লাস (Alteplase), ইউরোকাইনেজ (Urokinase), অ্যানজট্রিপ্লাস (Anistreplase)। বিটাব্লকার জাতীয় ওষুধ যেমন- অ্যাটেনলল (Atenlol), মেটোপ্রলল (Metoprolol), টিমোলল (Timolol) অবস্থা অনুসারে ইনজেকশন বা ট্যাবলেট দেওয়া হয়। রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে খেতে দেওয়া হয় অ্যাসপিরিন (Aspirin)। অ্যাসপিরিন রক্তকে সহজে জমাট বাঁধতে দেয় না। এছাড়াও আইসোসরবাইড ডাই নাইট্রেট (Iso sorbide dinitrate), গ্লিসারিল ট্রাই নাইট্রেট (Glyceryl trinitrate), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (Calcium channel blocker) ও আরো কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। এই ওষুধগুলি বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামে (Trade name) বাজারে পাওয়া যায়।
    হার্ট অ্যাটাকের অবস্থা সামাল দিতে রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করোনারি কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া উচিত। কাছে পিঠে করোনারি কেয়ার ইউনিট না থাকলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এইসব রোগীর জীবন বাঁচাবার জন্য নিদেনপক্ষে অক্সিজেন ও স্যালাইনের ব্যবস্থা করা দরকার।
     হার্ট অ্যাটাক সামাল দিতে হোমিওপ্যাথিতে অ্যাকোনাইট ফেরক্স (Aconite fer), এমিল নাইট্রেট (Amyl Nitrate), স্পাইজেলিয়া (Spigelia), ডিজিটেলিস (Digitalis), প্রভৃতি ওষুধ লক্ষণ অনুসারে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে ডাক্তারবাবুকে যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে।
    হার্ট অ্যাটাক হলো এমন একটি ব্যাধি যা অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিতে পারে। তাই সঁমীরবাবুর মতো আপনিও সুখস্বপ্নভরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করুন, ক্ষতি নেই। তবে সঙ্গে থাকুক অসুখকে প্রতিরোধ করার সুদৃঢ় প্রস্তুতি।

Join our mailing list Never miss an update