হৃদয়ের কথা পর্ব-৫;‘হৃদয়’ কি মন ? না হৃৎপিন্ড

হৃদয়ের কথা পর্ব-৫;‘হৃদয়’ কি মন ?  না হৃৎপিন্ড

হৃদয়ের কথা- ৫ পর্ব;‘হৃদয়’ কি মন ?  না হৃৎপিন্ড; ৭ অক্টোবর ১৯৯৬; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    সেদিন আমার কবি বন্ধু জীবকময় বেশ অভিযোগের সুরেই বললো- হৃদয় মানে হৃৎপিন্ড নয়। মন, অন্তর আরো কিছু...। পরক্ষণেই প্রশ্ন করলাম, তোমার অন্তর মন আছে কোথায়? নিজের অজান্তেই যেন তার হাতটি চলে গেল বুকের কাছে।
    হ্যাঁ, বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। শুধু আমার কবি বন্ধু কেন? অনেকেরই তো ধারণা হৃদয়-মন রয়েছে মানুষের বুকের মাঝে। ‘রামায়ণ’ বা ‘রামচরিত মানস’ যারা পড়েন নি, তারাও হয়তো পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখে থাকবেন সেই ছবি। হনুমান দু’হাতে নিজের বুক চিরে ফেলেছেন। রক্ত পড়ছে ঝর-ঝর করে। বুকের ভিতর বিরাজ করছে রাম ও সীতার যুগলমূর্তি।
    শরীর বিজ্ঞান সমন্ধে যারা সচেতেন তারা জানেন- আমাদের চিন্তা-ভাবনা, ভাব-ভালোবাসা সবই নিয়ন্ত্রিত হয় গুরুমস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম (Cerebrum)  থেকে। মন হ’ল সুবিশাল স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। গুরুমস্তিষ্কের মধ্যে রয়েছে এক লিম্বিক অংশ (Limbic Lobe)। বিজ্ঞানীরা একেই চিহ্নিত করেছেন প্রেম-আবেগের উৎসভূমি হিসাবে। লিম্বিক লোবের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চল আবেগের অভিব্যক্তিগুলি ছড়িয়ে দেয় শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে। আধুনিক গবেষণা থেকে জানা গেছে- প্রেম, ভালোবাসা ও এই সংক্রান্ত অনুভূতি সৃষ্টি হয় মস্তিষ্কের মধ্যে বিভিন্ন নিউরোকেমিক্যাল এর ক্রিয়া-ব্রিক্রিয়ার ফলে। আপনি যদি আলতোভাবে কারো হাত ধরে আবেগ ভরা সুরে কানে কানে বলেন-‘‘বহু দূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই, এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই’’। নতুবা স্টেশন-টার্মিনাস-মাঠে-বন্দরে অন্তর থেকে কাউকে বলে বসেন-‘‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল।’’ ব্যাস তাহলেই মস্তিষ্ক বিজ্ঞানীরা একটু মুচকি হাসবেন। মনে মনে বলবেন- ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি; তোমার লিম্বিক লোবে এখন এডিনিন-গুয়ানিন-সাইটোসিনের ভাঙ্গাগড়া চলছে। তোমার এই প্রেম গদ গদ কথা নিউক্লিয়প্রোটিনের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল।’’ ধরা যাক না, সেই অনাদিকালের কলাতলার মন্ত্র- ‘যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম।’ কার্ডিও সার্জেন শুনলে বলবেন-‘বদ্ধ পাগল! একই জায়গায় দু’জনের হৃৎপিন্ড? অসম্ভব।’

    এত কিছুর পরেও কেন মানুষ বহুকাল ধরে ভেবে এসেছে মন বা হৃদয় থাকে বুকের গভীরে? আসলে মানব মনের বিভিন্ন উত্তেজনার সঙ্গে পরিবর্তিত হয় হৃদয় স্পন্দনের হার। ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার সময় বেড়ে যায় ধুক্-পুক্। তাই দুরু-দুরু করে ওঠে বুক। প্রাচীন কালের মানুষ দেখেছিল উত্তেজনা, উদ্দীপনার সাড়া পাওয়া যায় বুকে। সে কারণেই হয়তো তারা ভেবেছিলেন বুকের খাঁচার মধ্যেই রয়েছে অন্তর-মন-বিবেক। সজীবতার লক্ষণ সমস্ত শরীরে ছড়ানো থাকলেও প্রাণের শব্দ একমাত্র পাওয়া যায় বুকের কাছে। হৃৎপিন্ড লাব্-ডুব্ ছন্দে অবিরাম সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে চলেছে। আদিম মানুষ প্রিয়তম বা প্রিয়তমার বুকে কান পেতে শুনেছিল সেই শব্দ। আর বুঝে ছিল, এ শব্দ থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু। যখন দেহজুড়ে আসে এক নিথরতা, যা চিরদিনের জন্য। পার্থিব জগতের প্রেম-ভালোবাসা থেকে এই চিরনির্বাসন তখনই হয়, যখন হৃদয়ের শব্দ আর শোনা যায় না।
    হৃদযন্ত্রের সিস্টোল ও ডায়াস্টোলের মধ্যেই যে প্রাণের গোপন চালিকাশক্তি লুকিয়ে আছে; হয়তো তা বহুকাল আগেই উপলব্ধি করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণকায়, রণপ্রিয় জুলু উপজাতির মানুষেরা। পরাজিত শত্রুর বুকচিরে বের করে নিত এই রক্তমাখা স্পন্দনশীল থলিটি, আর তৎক্ষণাৎ চালান করে দিত মুখের মধ্যে। শত্রুর প্রাণশক্তি নিয়ে তরতাজা হয়ে উঠবে ওদের প্রাণ, বেড়ে যাবে আয়ু অ্যাকাউন্টের ডিপোজিট। এই ভ্রান্ত ধারণা তাদের পরিচালিত করতো এই নৃশংসতার পথে।
   আবার নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা সেই পিরামিডের দেশ, সেখানে অন্য ধারণা। প্রাচীন ঈজিপ্টে যারা মমি সংরক্ষণ করতো, তারা মরা মানুষের পেট কেটে হৃৎপিন্ড বাদে সবই বার করে নিত। কিন্তু হৃদযন্ত্রে হাত দিত না। মিশরীয়রা মনে করতেন হৃৎপিন্ডই হল মানব আত্মার পীঠস্থল, খুবই পবিত্র জায়গা। এখানে হাত দেওয়া মানেই পরমাত্মার সঙ্গে হাতাহাতি করা। এসব বিভিন্ন কারণে মানুষ মাথা নিয়ে বেশি মাথা ঘামান নি। ভেবেছে মন, অন্তর, বিবেক সবই আছে পাঁজরের পিঞ্জরে।
    হৃদয়ের প্রতীক চিহ্ন বৃন্তহীন পান পাতা বা হরতন-এর সঙ্গে আমাদের হৃদ্যন্ত্রের আকৃতিগত অদ্ভুত মিল রয়েছে।
    ‘হৃদয়’ কথাটির মধ্যে প্রায় বিপরীতার্থক দুটি ধাতু আছে। ‘হৃ’ (হরণ করা বা নিয়ে নেওয়া) ও ‘দয়’ (দয়া বা অনুকম্পা করা)। অর্থাৎ যা হরণ করে ও দিয়ে দেয় তাই হ’ল হৃদয়। হৃৎপিন্ডের অলিন্দ প্রসারিত হওয়ার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত শুষে নেয়। আবার নিলয় যখন সংকুচিত হয় তখন সে রক্ত ছড়িয়ে দেয় সারা দেহে। সুতরাং হৃদয় হৃৎপিন্ড ছাড়া আর কী হতে পারে।
    তবুও আমার কবি বন্ধুরা কী বদলাবে তাদের হৃদয়ের অবস্থান? না কী, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উত্তোলিত করে বলবে- ‘‘কার তাতে কী, আমরা যদি এই অকালেও স্বপ্ন দেখি?’’

Join our mailing list Never miss an update