হৃদয়ের কথা পর্ব -২; হৃদয়ের বিবর্তন

হৃদয়ের কথা পর্ব -২; হৃদয়ের বিবর্তন

হৃদয়ের কথা পর্ব -২; হৃদয়ের বিবর্তন; -ডাঃ পার্থপ্রতিম। ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৬; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
শুধু আজ নয়। আগামীকাল-আগামী পরশু- প্রতিদিনের সূর্যোদয় আমার কাছে কাঙ্খিত। সে সকাল যেন না আসে- ‘‘যখন সেই প্রভাতে নেই আমি’’। জীবজগতের সকলে আরো সুখে, আরো ভালোভাবে বাঁচতে চায়। কতিপয় ছাড়া আর কেউ বলবেনা- ‘‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’’। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, অক্সিজেন, রেচন প্রভৃতি বস্তুর মিলিত দ্রবণ দেহের এক স্থান থেকে অন্যত্র পরিবাহিত হয়। এই পদ্ধতিকে এক কথায় বলে সংবহন (Circulation)। উচ্চ শ্রেণীর প্রাণীদের ক্ষেত্রে সংবহনের চাবি-কাঠি থাকে হৃৎপিন্ডে। বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে প্রাণীর জীবনযাত্রা। সেই একই সঙ্গে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে প্রাণীর অঙ্গ-তন্ত্র-হৃদয়।
    মানবসভ্যতায় ইতিহাস হলে নৃতত্ত্ববিদদের যেমন নাড়াচাড়া করতে হয় গুহালিপি-স্তম্ভলিপি নিয়ে, তেমনি জৈব বিবর্তনের দলিল দস্তাবেজ লুকিয়ে আছে হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয়ের খাঁজে খাঁজে। বানর মানুষেরই পূর্বপুরুষ এ সত্য যারা জেনে গিয়েছেন, তাদের কানে কানে বলি- কেঁচো, তারামাছ, আরশোলা এরা সবাই আপনার পূর্বপুরুষের পূর্বপুরুষ। না-না, রাগ করবেন না। প্রাণীর সংবহনতন্ত্রের ভেতরে লুকিয়ে আছে এ ঘটনার প্রমাণ। তারামাছ জাতীয় কাঁটাওয়ালা ত্বকের প্রাণীদেহে প্রকৃত রক্ত সংবহনতন্ত্র দেখা যায় না। কিন্তু বিকল্প রূপে হিমেল (Haemal) ও পেরিহিমেল (Peri haemal) তন্ত্র আছে। বর্ণহীন সিলোমিক তরল পদার্থ রক্তের মতোই কাজ করে। এদের সুনির্দিষ্ট হৃৎপিন্ড না থাকলেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন- পৃষ্ঠীয় থলি (Dorsal Sac) সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে হৃদয়ের মতো সারা দেহে অক্সিজেন ও খাদ্যবস্তু ছড়িয়ে দেয়।
    প্রাণীদের মধ্যে দুই প্রকারের সংবহনতন্ত্র দেখা যায়। চিংড়ি, আরশোলা প্রভৃতি প্রাণীদের ক্ষেত্রে রক্ত সবসময় রক্তনালী ও জালকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় না। রক্তনালীর মধ্যে দিয়ে রক্ত এসে হিমোসিল নামের দেহগহ্বরে ছড়িয়ে পড়ে; সেখান থেকে আবার হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে। এই সংবহনকে বলে মুক্ত সংবহন (Open Circulation)। কেঁচো, জোঁক, জাতীয় অ্যানিলিডা ও মানুষসহ সকল মেরুদন্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে রক্ত সর্বদা রক্তবাহনালীর মধ্য দিয়ে বয়ে চলে তাই একে বলে বদ্ধ সংবহন (Closed Circulation)।
    আমরা আগেই জেনেছি, হৃদয়ের ধর্ম হচ্ছে সংকুচিত ও প্রসারিত হওয়া। হৃৎপিন্ড যখন প্রসারিত হয় তখন  দেহের বিভিন্ন অংশ হতে রক্ত এসে এখানে সঞ্চিত হয়। আবার সংকোচনের সময় রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। হৃৎপিন্ডের অলিন্দ রক্ত গ্রহণ করে বলে একে গ্রাহক এবং নিলয় রক্তকে বের করে দেয় বলে; তাকে প্রেরক যন্ত্র বলে।
 মাছ থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সব প্রাণীরই বুকের মাঝে একটি করে হৃদয় লুকিয়ে আছে। তবে হ্যাঁ, সবার হৃৎপিন্ডের গঠন ও কর্মপদ্ধতি একরকম নয়। মাছের হৃদযন্ত্রটি প্রধানত দু’টি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত- একটি অলিন্দ ও একটি নিলয়।
সারা দেহ থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড যুক্ত রক্ত সাইনাস ভেনোসাসের মাধ্যমে অলিন্দে আসে। তারপর হৃৎপিন্ডের সংকোচনের ফলে নিলয় থেকে ফুলকায় (Gills) প্রবাহিত হয়। মাছের ফুলকার সাহায্যে রক্ত থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড জলে বেরিয়ে যায় আর অক্সিজেন রক্তে প্রবেশ করে। মাছের হৃৎপিন্ডে কেবলমাত্র শিরার মতো কার্বন-ডাই অক্সাইড পূর্ণ রক্ত প্রবাহিত হয়, তাই তাকে বলে ভেনাস হৃৎপিন্ড (Venus Heart)।
ব্যাঙ, সাইরেন (Siren), ইকথিওফিস (Ichthyophis), নেকটুরাস (Nectyrus) এইসব উভচর প্রাণীদের হৃৎপিন্ডে তিনটি কক্ষ থাকে। দু’টি অলিন্দ ও একটি নিলয়। এদের হৃদযন্ত্রের বাম অলিন্দ দিয়ে অক্সিজেন পূর্ণ শুদ্ধ রক্ত ও ডান অলিন্দ দিয়ে কার্বন-ডাই অক্সাইড পূর্ণ দূষিত রক্ত এলেও নিলয়ে তা একসঙ্গে মিশে যায়। হৃৎপিন্ডের প্রধান কাজ প্রতিটি সজীব কোষে অক্সিজেনপূর্ণ রক্ত পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু উভচরদের (Amphibia) হৃদয়ে একটি নিলয় থাকার জন্য তা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রাণীর বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি শ্রেণী থেকে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তরণ ঘটায় সঙ্গেই হৃদযন্ত্রের উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়।
প্রাণীর উন্নতি মানেই তার হৃদয়ের উন্নয়ন। উভচর প্রাণীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চাইছিল- তাদের হৃদযন্ত্রের নিলয়টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাক। উভচরের পরবর্তী শ্রেণী সরীসৃপের (Reptillia) মধ্যে দেখা যায় নিলয়ের অসম্পূর্ণ প্রাচীর (Incomplete Septum)। এই অসম্পূর্ণ প্রাচীর একটি নিলয়কে দু’টি করার সুরুয়াৎ বলা যেতে পারে। বুকে হেঁটে চলা প্রাণীদের মধ্যে যে প্রাণীটি সবচেয়ে শক্তিশালী তার হৃৎপিন্ডে আবার চারটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, কুমিরের কথাই বলছিলাম। সরীসৃপ শ্রেণীর প্রাণী হলেও কুমিরের হৃদযন্ত্রে দু’টি অলিন্দ ও দু’টি নিলয় দেখা যায়। অর্থাৎ কুমিরের পরবর্তীকালে যে সব প্রাণীরা এই পৃথিবীতে এসেছে যেমন- পাখি, স্তন্যপায়ী, মানুষ সবারই হৃদয়ে চারটি করে কুঠুরি রয়েছে।
মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখী ও মানুষ এইসব বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণীদের হৃৎপিন্ডের গঠনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, এসব প্রাণীদের হৃদয়ের গঠনের মধ্যে একটা মৌলিক মিল রয়েছে। হৃৎপিন্ডহীন প্রাণী থেকে যে আজকের হৃদয়বান মানুষের সৃষ্টি; তা সহজেই ধরা পড়ে। জীবজগতের এই বিবর্তন একদিনে হয় নি। এর জন্য কেটে গেছে কোটি কোটি বছর, এক পর্ব থেকে আর এক পর্বে উত্তরণ ঘটতে। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের- ‘ডায়লেকটিক্স অব নেচার’ বইটি যারা পড়েছেন তারা জানেন- জৈব বিবর্তনের পেছনে রয়েছে শ্রমের ভুমিকা। প্রাণ থেকে প্রাণে এই এগিয়ে চলার ধারা ২৫০ কোটি বছর ধরে চলেছে। এটা কী মানুষে এসেই থেমে গেছে? না, কিছু জীববিজ্ঞানী তা মানতে রাজী নন। অনেকেই মনে করেন আগামীতে মানুষের চেয়েও কোনো উন্নত হৃদয়বান প্রাণীর আবির্ভাব ঘটবে এই পৃথিবীর বুকে। এসব বিতর্কের সঠিক উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে- ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে. . .’।

Join our mailing list Never miss an update