জলফড়িং থেকে যুদ্ধবিমান; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২৮বর্ষ, আগষ্ট -২০০৩, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৩৩; জ্ঞান বিচিত্রা(ত্রিপুরা) পত্রিকায় প্রকাশিত
ফ্লোরে সাদা ধোঁয়া ছড়ান, ক্যামেরাম্যান তাঁর হাইস্পিড মুভি ক্যামেরার লেন্সটিকে আরো একবার মুছে নিলেন। চিরিস সোমপ্ (Chris Somps)ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে শেষ পরামর্শটুকু সেরে নিচ্ছেন। আলো প্রক্ষেপকও তৈরি। শুরু হল অ্যাকশন....।
না না, এ কোন চলচ্চিত্রের শুটিং নয়। সোমপ্ কোন চিত্র পরিচালক নন, একজন বিমান প্রযুক্তিবিদ। হ্যাঁ, অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার, কোলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারের প্লেক্সিগ্লেস (Plexiglass) চেম্বারে জলফড়িং-এর ওড়ার কৌশলের ওপর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছেন একদল বিমান প্রযুক্তিবিদ।
জলফড়িং ড্রাগনফ্লাই (Dragonfly) এই পৃথিবীতে এসেছে কার্বোনিফেরাস কালে (Carboiniferous period) ৩৫ কোটি বছর। এই মাটি ছেড়ে আকাশে পাখা মেলেছিল পাখি আসার ২১ কোটি বছর আগে। জলফড়িংয়ের ওড়ার কৌশল বহু বছর আগে থেকেই মানুষের মনে সৃষ্টি করেছিল বিস্ময়। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ উড়ন্ত অবস্থায় পুরোপুরি ডান বা বাম পাশে ঘুরতে জায়গা লাগে প্রায় ৫০.৭০ মাইল। আর জলফড়িং তার দেহের দৈর্ঘ্যের সমান দূরত্ব যেতে যেতেই ৯০ ডিগ্রি কোণে ওড়ার সময় অত্যাধুনিক এফ-১৬ বিমান বায়ুস্তরের ওপর যে ঘাত সৃষ্টি করে জলফড়িং-এর উড্ডয়ন ঘাত তার প্রায় তিনগুণ। ড্রাগনফ্লাই-এর স্বচ্ছ দু’জোড়া পাখনা একসঙ্গে ওপর নিচ করে না। সামনের জোড়া পাখনা নিচে নেমে এলে, পিছনের পাখনা জোড়া ওপরে উঠে যায়।
বোলতা, পঙ্গপাল আর সব পতঙ্গ যে অন্তরীক্ষে উড়ে বেড়ায় না তো নয়। তবে জলফড়িং-এর বাতাস কেটে চলার ভঙ্গিই আলাদা। বিমান প্রযুক্তির পরিভাষায়, যাকে বলে ‘আন স্টেডি ফ্লো (Unsteady Flow)। ডানা নাড়ানর ছন্দে তৈরি হয় ছোট টর্নেডো ঝড়। এক সেকেন্ডের মধ্যে এরা ১০ থেকে ১২টি টর্নেডো সৃষ্টি করতে পারে। তাই এরা নিজের ওজনের বিশগুণ ভারি শিকার নিয়ে স্বচ্ছন্দে উড়ে যেতে সক্ষম।
বিমান বা যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল যখন তাকে আকাশের বুকে স্থির হয়ে থাকতে হয়, সে সময়ে ভারসাম্য রক্ষা করা। অত্যাধুনিক এফ-১৬ বিমানকেও বেশিক্ষণ এক জায়গায় ভেসে থাকতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। জলফড়িং-এ কাজটি বেশ সহজ ভাবেই করে থাকে। ১৯৮০ সালেই জলফড়িংয়ের ভঙ্গি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। চিরিস সোমপ ও তাঁর সহযোগী মার্ভিন লুট্টগেস(Marvin Luttges)বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পুকুরের আশেপাশে টেলিফটো লেন্স ও হাইস্পিড ক্যামেরা নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালান। ফড়িং ধরার জাল হাতে ঘুরতে থাকা দুই বিজ্ঞানীর কান্ডকারখানা অনেকেই সেদিন দেখেছিলেন বুড়ো বয়সে ছেলেমানুষী হিসেবে। কিন্তু এসবেও সঠিক সমাধান হল না। জলফড়িং ওড়ার সময় বায়ুস্তরের ওপর কিভাবে চাপ দেয় ও তার ফলে বাতাসে অভিমুখ গতি কিভাবে পাল্টায় তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, বাতাস তো আর চোখে দেখা যায় না।
লুট্টগেস এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলেন সেক্সপীয়ার উৎসব দেখতে। সেদিন চলছিল ‘ম্যাকবেথ’ পালা। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে আসছিল সেই পেতনী-ভূত ম্যাকবেথকে ভবিষ্যতের বাণী শোনাতে। সেদিন রাতে লুট্টগেস ঘুমোতে পারেননি। সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছেন। না, ভূত-পেতনীর চিন্তায় নয়। দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের এক পথের সন্ধান পেয়ে সাত-সকালে উঠে ছুটলেন ল্যাবরেটরিতে সোমপ-এর সঙ্গে পরামর্শ করতে। তারপর তৈরি হল প্লেক্সিগ্লেস চেম্বার। সাদা ধোঁয়া ভরা বাক্স, যে ধোঁয়া পতঙ্গের ওপর বিষক্রিয়া করে না। অদৃশ্য বাতাসের পরিবর্তে দৃশ্য মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলতে লাগল ড্রাগনফ্লাই।
সোমপ, লুট্টগেস এর গবেষণা থেকে অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। মার্কিনী যুদ্ধবিমান নির্মাণ সংস্থাগুলি খুবই আনন্দিত। এর মধ্যেই দুই গবেষক জলফড়িং-এর কৌশল নকল করে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমানের প্রোটোটাইপও (Prototype) তৈরি করে ফেলেছেন। বিমানের মূল ডানার সঙ্গে লাগান থাকবে ছোট ছোট পাখনা, যেগুলি প্রয়োজন মত নড়াচড়া করে মজার খেল দেখাবে দূর আকাশের বুকে। আর কী, যখন ৩৫ কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাকৃতিক উড়ানের রহস্য উন্মোচন হয়েছে বিজ্ঞানীদের বিনিদ্র রাতের বিনিময়ে।