গর্ভপাতকারী খাবার
গর্ভপাতকারী খাবার; -ডাঃ পার্থপ্রতিম। ; ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
গর্ভাবস্থায় খাবার-দাবারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ব্যাপারে যেমন আগ্রহী হতে হয়, তেমনই সতর্কতাও অবলম্বন করতে হয়। একসময়ে ধারণা করা হতো, গর্ভাবস্থায় শাকসবজি, ফলমূল, দানাশস্য জাতীয় খাবার গ্রহণে কোনো বাধা নেই। কিন্তু উৎকৃষ্ট পুষ্টিমান, গুণসম্পন্ন এইসব খাবার গর্ভাবস্থায় রান্না না করে খাওয়ার কারণে গর্ভপাত হতে পারে।
গর্ভপাতকারী এইসব শাকসবজি, ফলমূল ও শস্যদানার তালিকায় রয়েছে: পেঁপে, আনারস, চিনাবাদাম, কাজুবাদাম সহ সব রকমের বাদাম, পেস্তা, গাজর, বিট, বাঁধাকপি, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, আলু, শাকালু, রাঙা আলু ছোলা এসব। উল্লেখিত খাদ্যগুলো রান্না না করে খেলে সেগুলো গর্ভপাত ঘটাতে পারে। কারণ এই খাদ্যগুলোতে রয়েছে এমন কিছু উপাদান যা ভ্রুণশিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যেহেতু ভ্রুণশিশু মায়ের রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টিচাহিদা পূরণ করে থাকে, তাই মায়ের শরীরে প্রবেশকারী অধিকাংশ উপাদানের প্রভাব ভ্রুণশিশুর ওপর পড়তেই পারে। কাজেই ভ্রুণশিশুর জন্য অসহ্য যে কোনো উপাদান মায়ের শরীরে ক্রমাগত ঢুকতে থাকলে ভ্রুণের ক্ষতি হতে পারে। আর এই ক্ষতি পরিণামে গর্ভপাতকেই আমন্ত্রণ জানায়।
উল্লেখিত খাবারগুলো কেন গর্ভপাত ঘটায় এ নিয়ে যতটুকু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে :
-
পেঁপে ও আনারসের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন ভেঙে ফেলার বা হজম করে ফেলার মতো এক ধরনের এনজাইম তথা উৎসেচক। অর্থাৎ এক ধরনের প্রোটিওলাইটিক এনজাইম। এই এনজাইম প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলের ক্ষতি করতে পারে।
-
বাদাম পেস্তা জাতীয় খাবারে রয়েছে সায়ানো গ্লাইকোসাইড নামের রাসায়নিক যৌগ, যা শরীরে এক ধরনের বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড তৈরি করতে পারে। হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড ভ্রুণশিশুর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। অতিরিক্ত মাত্রায় এই হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড শ্বাসতন্ত্রের প্যারালাইসিস ঘটাতে পারে।
-
ছোলায় রয়েছে বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী যৌগ লেকটিন বা হেমএগ্লুটিনিন যা গর্ভফুলের সেলমেমব্রেন তথা কোষ- আবরণীকে নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে গর্ভফুলের মধ্যে দিয়ে ফিলট্রেশন ট্রান্সপোর্টেশন, ডিপিউশন প্রক্রিয়ায় ভ্রুণশিশুর জন্য মায়ের শরীর থেকে খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এতে করে ভ্রুণশিশুর মৃত্যু এবং গর্ভফুলের ক্ষতি হয়ে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে।
-
বিট, গাজর এসবে থাকে ফাইটোইস্ট্রোজেন জাতীয় পদার্থ। এগুলোর মধ্যে থাকে আইসোফ্ল্যাভোনয়েড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ। যা জরায়ুর সঙ্গে ভ্রুণের সংযোগ স্থাপনে বাধা দেয়। ফলে এক পর্যায়ে গর্ভপাত ঘটে।
-
আলু-শাকালু-রাঙা আলুতে থাকে সোলানিন। এটি অ্যালকালয়েড জাতীয় পদার্থ। যা মানবদেহের স্নায়ুতে অবস্থিত কোলিনইস্টারেজ এনজাইমের বাধাদানকারী হিসাবে কাজ করে থাকে। ফলে গর্ভবতী মা তথা ভ্রুণশিশুর স্নায়ুচাঞ্চল্য বেড়ে গিয়ে স্বাভাবিক স্নায়বিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে। তবে একটা কথা, এইসব খাবার রান্না না করা অবস্থায় খেলেই বিপত্তি হতে পারে। রান্না করে বা সেদ্ধ করে খেলে খাদ্যের বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তাই রান্না করা অবস্থায় এগুলো খেলে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বা কখনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না। যদিও আনারস, গাজর এবং বাদাম ছাড়া এইসব খাদ্যের কোনোটিই সাধারণত রান্না না করে খাওয়া হয় না। যা হোক তারপরও গর্ভাবস্থায় এই খাবারগুলো অবশ্যই রান্না করে অর্থাৎ সেদ্ধ করেই খাওয়া উচিত।
-
তারপরও কিছু কথা আছে: এইসব খাদ্যের বিষক্রিয়া সবার ওপর সমানভাবে কার্যকর নাও হতে পারে। দেখা গেল কোনো এক মহিলা গর্ভাবস্থায় প্রচুর আনারস খেলেন, তাঁর কিছুই হল না। এইসব খাদ্যের বিষক্রিয়ার প্রতি কে কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ তা ব্যক্তিবিশেষের বংশগতির অর্থাৎ জিনের ওপর নির্ভরশীল। দেখা গেছে এইসব বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী যৌগ একেক জনের ওপর একেক মাত্রায় কাজ করে। কিন্তু কার ওপর এই বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী যৌগ তীব্রভাবে চড়াও হবে, আর কাকে মৃদুভাবে আক্রমণ করবে তা বলাটা সহজ নয়। আগে থেকে এ সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিনই বলা যায়, অন্তত আমাদের দেশে সে ধরনের কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাই নেই। কাজেই এ অবস্থায় ঝুঁকি না নিয়ে গর্ভাবস্থার দিনগুলোতে এই খাদ্যগুলো রান্না না করে খাওয়া থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে জটিলতা এড়ানোর একমাত্র উপায়। সুতরাং গর্ভাবস্থায় রান্না না করে সবজি খাওয়া ভালো, এমন ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
-
ঘি খেলে কি প্রসবে সুবিধা হয়? এই ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কেউ যদি ঘি খেয়ে খান, তাহলে সেই ঘি হজম হওয়ার পর কোনো ক্রমেই জরায়ু মুখে সঞ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। বরং ঘি হজম হওয়ার পর ত্বকের নিচে অর্থাৎ শরীরে জমা হতে পারে। চর্বি হিসাবে। ঘি হজম হয়ে ঘি-র মতো একই গাঠনিক অবস্থানে থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রসবের সময় প্রসবের পথ পিচ্ছিল করতে প্রাকৃতিকভাবেই সময়মতো এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থ বাচ্চা যে পাতলা পর্দার থলিতে থাকে সেটা ফেটে বেরিয়ে আসে। এজন্য ঘি খাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। তাই ঘি খেলে প্রসবের পথ পিচ্ছিল হবে, এমন কথার কোনো ভিত্তি নেই