এথেলবাড়ির সুশীতল তপোবন; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৪ আগস্ট ২০০২; রবিবারের সাময়িকীতে উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
দোলনা, বোটিং, রোপওয়ে, ভুটানি মদের চোরাগোপ্তা ঠেক..। না, এসব কিছুই নেই। এ এক ব্যতিক্রমী জায়গা ছায়া সুশীতল তপোবন।
গয়েরকাটা বা বিন্নাগুড়ি থেকে বীরপাড়া যাওয়ার পথে পড়বে এথেলবাড়ি মোড়। বাস থেকে নেমে রিকশা-ভ্যান চালককে বললেই হল-আশ্রম যাব। খগেনহাট যাওয়ার রাস্তায় তিন কিমির পথ। পাকারাস্তার পাশে দয়ানন্দ বিদ্যাপীঠ-এর কোল ঘেঁষে বাঁ হাতে ঢুকে গেছে গাড়ি চলাচলের উপযোগী কাঁচা রাস্তা। একটু গেলেই পৌঁছে যাবেন শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ সারদা সাধনালয়ে।
ষাট বিঘা জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেগুন-বট-নিম-কদম শিরীষের গাছ। মাঝে বিঘা চারেকের জায়গা। গেট দিয়ে ঢুকে উত্তরদিকে রয়েছে বিরাট বড় নাটমন্দির। এখানে দুর্গাপুজোর সময় তিনদিন ধরে চলে কুমারীপুজো। প্রায় ১৮-২০ হাজার মানুষের সমাগম হয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের জন্মোৎসবে চলে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন, ভক্তিগানের আসর।
আদি আশ্রম ছিল ত্রিপুরায়। ১৯৬৭ সাল থেকে দয়ানন্দ মহারাজ ও তাঁর শিষ্যা বাণীমা এখানে এসে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। জলপাইগুড়ি শহরের তৎকালীন শিল্পপতি এস. পি. রায়ের কাছ থেকে ৬০ বিঘা জমি কিনে আশ্রমের গোড়াপত্তন হয়। তারপর স্থানীয় মানুষ ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অনুরাগীদের সহযোগিতায় তিল তিল করে গড়ে ওঠে আশ্রমিক পরিবেশ। দয়ানন্দ মহারাজ ১৯৭১ সালে দেহ রাখেন।
স্থানীয় শিশুদের পড়াশোনার সুবিধার্থে আশ্রমের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয় দয়ানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরবর্তীতে জলপাইগুড়ির অন্যতম কৃতী সন্তান স্বর্গীয় ডঃ চারু সান্যালের পরামর্শে এর পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্কুল বোর্ডের হাতে। ডি বি আই টি এ-র আর্থিক সহায়তায় এখানে তৈরি হয়েছে দ্বিতল আশ্রমিক আবাস। বর্তমানে এখানে রয়েছেন ২৫ জন সন্ন্যাসী, সন্নাসিনী।
আশ্রমিক আবাসের একতলায় রয়েছে বিরাট সিংহাসন। তাতে বিরাজ করছে দয়ানন্দ মহারাজের ধ্যানস্থ মূর্তি। এ ঘরের দেওয়াল আলমারিতে রয়েছে গীতা, উপনিষদ, বেদান্ত, রামকৃষ্ণের কথামৃত, বিভিন্ন গ্রন্থের সম্ভার।
আশ্রমের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ফুলের বাগান। গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, দোপাটি আরো কত নাম না জানা ফুলের ঝাড়। উঁচু নারকেল গাছের পাতায় বাসা বুনে চলেছে ব্যতিব্যস্ত বাবুইপাখি। ঘুঘু দম্পতি রোমান্স করছে কদম গাছের ডালে।
প্রকৃতির এক নিজস্ব মাদকতা আছে। এখানে গাছ-গাছালির ফাঁকফোকরে লেপটে রয়েছে সেই মৌতাত। অন্য কোন মাদক দ্রব্যে যাদের আসক্তি নেই, এ আশ্রম তাদের কাছে স্বর্গরাজ্য। জাতি- ধর্ম-বর্ণভেদ নেই, সবার জন্য মুক্ত অঙ্গন। পশ্চিমদিকে বটবৃক্ষের নিচে রয়েছে দর্শনার্থীদের বসার জন্য উঁচু শান বাধাঁনো বিরাট চাতাল।
সাধনালয়টি চলে স্বনিয়ন্ত্রিত সমিতি দ্বারা। সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন বা আয়কর ছাড়, সরকারি অনুদান এসব কোনো ব্যবস্থা এরা করেননি। ভক্ত ও অনুরাগীদের আর্থিক সহায়তা আশ্রম পরিচালনার মূল ভিত্তি। বাণীমার কথায়-‘এসব করতে গেলে কাগজপত্র, হিসাবনিকাশ-এর অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। ইট উইল বিকেম মোর অফিশিয়াল দ্যান স্পিরিচুয়াল।’
সাধনালয়ের পূর্বদিকে রয়েছে দু’টি মাথাতোলা মন্দির। একটি দয়ানন্দ মহারাজের সমাধি। পাশেরটিতে থাকা শ্রী রামকৃষ্ণ-সারদা মার শ্বেতপাথরের মূর্তি আপনার মন কেড়ে নেবে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
শিলিগুড়ি পি সি মিত্তাল বা তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে বীরপাড়াগামী বাসে করে এথেলবাড়ি মোড়ে নামা যায়। মালবাজার-বানারহাট হয়ে বাসগুলি আসে। সময় লাগে আড়াই ঘন্টা। বাসভাড়া ৩৫ টাকা।
শিলিগুড়ি রেল জংশন থেকে সকাল ৬টায় প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছেড়ে সকাল ৯টায় দলগাঁও (বীরপাড়া) পৌঁছায়। সেখান থেকে সবসময় এথেলবাড়ি মোড়ে আসার বাস পাওয়া যায়। আশ্রম দেখে ফিরতি ট্রেনে বেলা ছ’টায় বীরপাড়া থেকে ট্রেনে করে শিলিগুড়ি ফিরে যেতে পারেন। কিছু সংখ্যক লোকের জন্য রাত্রিবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আগে থেকে যোগাযোগ করে আসতে হবে। ঠিকানা-
অধ্যক্ষা শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ সারদা সাধনালয়,
ডাক: নরসিংহপুর (ভায়া বীরপাড়া),
জেলা : জলপাইগুড়ি,
ডাকসূচক : ৭৩৫২০৪,
দূরভাষ : (০৩৫৬৩) ৬৪৩১৯।