হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙলেন মানসবাবু; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ৩০ মে ২০০৪ পৃষ্ঠা- দশ; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিতকয়েকজন চিন্তাশীলের মগজে মগজে কথাটি ঘুরছিল..। হাটের মাঝে (বইয়ের পাতায়) হাঁড়ি ভাঙলেন মানসবাবু। ‘উদারীকরণ উন্নয়ন ও উত্তরবঙ্গ’ শীর্ষক বইটির মুখবন্ধে জানিয়ে দিয়েছেন - ‘উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতার বহু পত্রিকা বর্তমানে বের হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষের জন্য দু-চার পাতা যোগ করে তাঁরা একটি উত্তরবঙ্গে সাপ্লিমেন্ট বের করেন। এটি আবার দক্ষিণবঙ্গের পাঠকের কাছে যায় না- কলকাতাতেও যায় না।’
হ্যাঁ, মানসবাবুর এই লেখার মধ্যে এক অদ্ভুত বেদনার দ্যোতনা লুকিয়ে আছে। উত্তরবঙ্গের ব্যথা বেদনার গল্পগাথা ছাপা হয় কলকাতা থেকে আসা মগজে, যা আর গঙ্গাই পেরোয় না। পলিসি মেকাররা ওই পাড়ে- আর সমস্যার পাহাড় এই পাড়ে, মাঝখানে গঙ্গা ওই বয়ে চলে যায়। সেকারণেই হয়তো মুখ্যমন্ত্রী এতো জোরগলায় বলতে পারেন - ‘বন্ধ চা বাগানগুলিতে অনাহারে কেউ মারা যায়নি।’ না, মন্ত্রীমহোদয় ডাহা মিথ্যে বলেননি। সত্যিই অনাহারে কেউ মারা যায়নি। কোনোকালে কেউ মারাও যায় না। নিরন্ন মানুষ খিদের জ্বালায় কচু-ঘেঁচু খেয়ে ডাইরিয়া-অপুষ্টিতে মরে।
মানস দাশগুপ্তের এই ৩২৬ পাতার বইটি প্রবন্ধ সংকলন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অর্থনীতির বিবিধ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জনপ্রিয় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে চলেছেন। সেগুলি বন্দি হল দু-মলাটে। বইটির প্রথমদিকে ‘উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন সমস্যা ও সমাধানের উপায়’ লেখাটি পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন লেখক এ অঞ্চলকে হাতের তালুর মতো চেনেন। না, শুধু চেনা নয়। এই ভূখন্ডের অরণ্য-ধ্বংস, বন্যা, জনসংখ্যা-স্ফীতি, চা শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে লেখক আন্তরিকভাবে চিন্তিত। ডঃ দাশগুপ্ত দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপনা করেছেন। বিষয়গত জ্ঞান যে তাঁর যথেষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আঞ্চলিক অর্থনীতি নিয়ে এর আগেও অনেক লেখালেখি করেছেন। তবে ডঃ দাশগুপ্তের প্রবন্ধ গুলি পড়লে বোঝা যায়, তিনি উত্তরবঙ্গের সমস্যা, ব্যথা বেদনার সঙ্গে সমব্যথী। প্রতিটি রচনাতেই মানবিক আবেদন স্পষ্ট। প্রশাসনিক দুর্নীতি, আমলা-মন্ত্রিদের অশুভ আঁতাত, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, নেতাদের দুর্নীতিপরায়ণতা সব বিষয়ে তার নির্ভীক লেখনী পাঠকের প্রাণে অনুরন তোলে। এ ভুখন্ডের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী (তথাকথিত) যখন ক্ষমতাসীনের পায়েরতলার জমি হা-ভাতের মতো চেটে চলেছেন, পাছে বড়োকর্তার গোঁসা হয় সেই আশঙ্কাতে আঞ্চলিক সমস্যা বিষয়ে নিজের চিন্তাভাবনাগুলি প্রকাশকরতে নারাজ, অথবা যা কিছু বলেন তাই হিজ মাস্টারস ভয়েস; সেখানে মানসবাবুর এই সাহসী পদক্ষেপ শিক্ষিত নবীন প্রজন্মকে সত্যের সপক্ষে বাক্সময় করে তুলবে বলে আশা করা যায়। অর্থনীতি একটু খটমটে বিষয়। অন্তত সেভাবেই এটিকে দেখানো হয়। অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের লেখা বা বক্তৃতায় জি ডি পি, এইচ পি আই, আই এম আর-আরো বহু সংক্ষিপ্ত পরিভাষা বা অ্যাব্রিভিয়েশন অতিদ্রুত ব্যবহার করেন। যার ফলে সাধারণ মানুষের মগজে বিষয়টি কোনোভাবেই ঢোকে না। সে কারণে অর্থনীতির ছাত্রছাত্রী ও উচ্চবুদ্ধিজীবীর মধ্যেই শাস্ত্রটি সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আমজনতার নিত্যদিনের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এটি সাধারণের অবোধ্য। অধ্যাপক দাশগুপ্তের এই বইটিতে ব্যবহৃত প্রতিটি পরিভাষা প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। বাক্যগঠন ও প্রকাশভঙ্গি মেদবিহীন, ঝরঝরে। পরিসংখ্যানগুলির উপস্থাপনা সহজবোধ্য। সাধারণ পাঠককে কখনোই হোঁচট খেতে হয় না।
না, শুধু তাত্ত্বিক কচকচানি নেই। লেখকের রসবোধও যথেষ্ট। একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যাক-‘কথিত আছে বোম্বাই সিনেমার স্বনামধন্য অভিনেত্রী নার্গিস শ্রীসত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা সন্মন্ধে যে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, তা হচ্ছে এই সিনেমায় ভারতীয় দারিদ্র্যের ছবি আছে। আন্তর্জাতিক মহলে এই ছবি দেখানো উচিত নয়। আমাদের আসল অবস্থা কী তা বিদেশিদের জানাবার দরকার কি? বরং বোম্বে সিনেমা প্রাচুর্য মারামারি কাটাকাটি গান-বাজনা দেখানো উচিত। ... বিদেশের কাছে কানাকে পদ্মলোচন বলে অভিহিত করলে ক্ষতি কি?
মানস দাশগুপ্ত তাঁর বইতে অর্থনীতির পাশাপাশি নারীমুক্তি ও মানব অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রবন্ধ লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘মানবাধিকার ও গুয়ানতানামো বে’ লেখাটি পড়লে বিশ্বমানব অধিকার নিয়ে আমেরিকার দ্বিচারিতার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে যায়। কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত গুয়ানতানামো বে আমেরিকার নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি। বিভিন্ন যুদ্ধবন্দিদের এখানে এনে রাখা হয়। রেডক্রশ ও জেনিভা কনভেনশনের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বন্দিদের উপর এখানে চালানো হয় আমানুষিক নির্যাতন। ঠিক কত সংখ্যক বন্দি এখানে আছেন তার প্রকৃত সংখ্যাটা বাকি বিশ্বের অজানা।
লেখাটি মর্মস্পর্শী। তবে অতিশয় উক্তি আছে -‘ধরা যাক ১৯৮৮ সালের ৩রা জুলাই -এর ঘটনা। আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজ ভিনসেনে কিছু মিসাইল ছিল। হঠাৎ আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজের নাবিকদের মজা করার ইচ্ছা হল। আকাশে মিসাইল ছুড়ে একটি ইরানি এরোপ্লেনকে গুলি করে নামাল। ২৯০ জন যাত্রী ওই প্লেনে ছিল। সব ইরানিরাই মারা গেল।’
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার খবর থেকে জানা যায়- আসলে জাহাজে থাকা স্বয়ংক্রিয় মিসাইল-লঞ্চার যান্ত্রিক গোলযোগ থেকে এই দুর্ঘটনা।
এছাড়া মানসবাবু এক জায়গায় লিখেছেন-‘বায়োডাইভারসিটির দিক থেকে উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল অনন্য। এর তুলনা শুধু ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলের সঙ্গেই চলে।’ হয়তো বা উত্তরবঙ্গের প্রতি অতি মমত্বের কারণে এ মন্তব্য। বায়োডাইভারসিটির নিরিখে কেরলের সাইলেন্ট ভ্যালি বা ম্যানগ্রোভ অরণ্য উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল থেকে অনেক এগিয়ে।
বইটির প্রবন্ধগুলির বিন্যাস বড়োই এলোমেলো। যা সিরিয়াস পাঠকের পঠন-ছন্দ নষ্ট করে। প্রবন্ধ নিবন্ধগুলিকে বিষয়ভিত্তিক গোষ্ঠীভুক্ত করা উচিত ছিল (যেমন- উত্তরবঙ্গ বিষয়ক, দেশীয়, আন্তর্জাতিক, মানব অধিকার)। মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়ার মতো। এ ধরনের আকরগ্রন্থে প্রকাশকের আরো যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। এসব সত্ত্বেও বইটি চিন্তাশীল বাঙালির অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে।
‘উদারীকরণ উন্নয়ন ও উত্তরবঙ্গ’; ডঃ মানস দাশগুপ্ত; বইওয়ালা; কলকাতা-৪৮; দাম-১২০/-