“মহাবিশ্বের বিস্ময় নিউট্রন নক্ষত্র”

“মহাবিশ্বের বিস্ময় নিউট্রন নক্ষত্র”

“মহাবিশ্বের বিস্ময় নিউট্রন নক্ষত্র”; -ডাঃ পার্থপ্রতিম।২০শে মে, সোমবার, ১৯৯১ (পৃষ্টা তিন) ‌'গণশক্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত

আমাদের এই মাটির পৃথিবী থেকে দূর-দূরান্তরের মহাকাশে ছড়িয়ে আছে কত বিস্ময়কর, কত রহস্যজনক বস্তু। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত সাধনার ফলে, তত্ত্ব ও তথ্য উভয় দিকেই যে সব চমকপ্রদ আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে, নিউট্রন নক্ষত্র তাদের অন্যতম।
    পরমাণু বা পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে, ধনাত্মক কণিকা প্রোটন ও তড়িৎ নিরপেক্ষ নিউট্রন কণা। এদের চারদিকে চক্রাকারে ঘুরছে ঋণাত্মক ইলেকট্রন। সূর্য ও আর সব নক্ষত্রের উত্তাপ প্রচন্ড বেশি। সে কারণে তাদের পরমাণু থেকে এক বা তার বেশি ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলে আয়ন। বেশ কিছুকাল আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন কয়েকটি নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছেন, যারা শুধুমাত্র নিউট্রন কণা দিয়ে তৈরি। এদের নাম দেওয়া হয়েছে নিউট্রন নক্ষত্র বা নিউট্রন স্টার।
    সাধারণত, মহাকাশের ধূলিকণা ও গ্যাস মিলে নক্ষত্রের জন্ম হয়। যদি প্রচুর পরিমাণে বস্তু একত্রিত হয়, তবে ক্রমশ মধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে ঘনত্ব ও তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এভাবে এক সময় পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু হয়। উৎপন্ন পারমাণবিক শক্তি প্রধানত তাপ ও আলোক শক্তিতে বিকিরিত হতে থাকে। বিকিরণের বহিঃমুখী টান মধ্যাকর্ষণের অন্তঃমুখী সংকোচনকে প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু বহুকাল পরে যখন পারমাণবিক বিক্রিয়া থেমে যায় অর্থাৎ পারমাণবিক জ্বালানী ফুরিয়ে আসে, তখন বিকিরিত শক্তি মধ্যাকর্ষণকে প্রতিরোধ করে না। নক্ষত্রের ভিতরের অংশ সংকুচিত ও বাইরের অঞ্চল প্রসারিত হতে থাকে। এই অবস্থায় প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ফলে বাহির অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সংকোচনের জন্য নক্ষত্রের ভিতরের অংশের বস্তু-ঘনত্ব যদি খুব বেড়ে একটি বিশেষ মাত্রা ছড়িয়ে যায়, তবে সমস্ত পরমাণুর ইলেকট্রন ও প্রোটন কণা মিলে নিউট্রনে রূপান্তরিত হয়। এই হল নিউট্রন নক্ষত্র সৃষ্টির রহস্য।
১৯৩২ সালে নিউট্রন কণিকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বিখ্যাত পদার্থবিদ লাস্তাউ নিউট্রন নক্ষত্রের আভাস দিয়েছিলেন। পরের বছরই দুই জ্যোতিবির্দ ‘কা’ডে ও জুইকি নিউট্রন নক্ষত্রের সৃস্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। গঠন সম্বন্ধে প্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ১৯৩৯ সালে। এরপর দীর্ঘকাল এ বিষয়ে গবেষণা বন্ধ থাকে। এর প্রধান কারণ এ ধরনের বস্তুর প্রকৃত অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিজ্ঞনীরা ক্রমশ সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন।
১৯৬৭ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জ্যোর্তিবিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন- কিছু নিহারিকা ও নিষ্প্রভ নক্ষত্র থেকে ঝলকে ঝলকে বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ আসছে। শুধু তাই নয়, যে কোন দুটি ঝলকের মধ্যের সময়ের ব্যবধান নিখুঁত ভাবে সমান। ঝলকের ইংরাজী প্রতিশব্দ পালস সেই অনুযায়ী এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘পালসার’। বর্তমানে প্রায় দেড়শো-র বেশি পালসার আবিষ্কৃত হয়েছে। পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া পালসারের গুণাবলী পরীক্ষা করে জ্যোর্তিবিদরা একমত হয়েছেন যে, নিউট্রন নক্ষত্রের দ্রুত ঘূর্ণনের ফলে পালসার সৃষ্টি হয়। নিউট্রন নক্ষত্র পৃথিবীর মতোই নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরছে। সাথে সাথে নক্ষত্রের দুই চুম্বক - মেরু বারবার বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ বিকিরণ করে চলেছে। জাহাজ বন্দরের লাইটহাউস থেকে দূরে বসে থাকলে লাইটহাউসের আলো যেমন খানিকক্ষণ পরপর পর্যবেক্ষকের চোখ ছুঁয়ে যায়, ঘূর্ণায়মান নিউট্রন স্টারের চুম্বক মেরু বরাবর নির্গত তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গও তেমনিভাবে পৃথিবীতে অবস্থিত বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্রে একবার করে সাড়া জাগিয়ে যায়। এগুলিই এক একটি ঝলক বা পালস। স্বভাবতই ঝলকের পর্যায়ক্রমে নির্ভর করবে নিউট্রন নক্ষত্রের ঘূর্ণন বেগের উপর।
    অঙ্ক কষে দেখা গেছে, যে সব নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের চার থেকে আট গুণ, তারাই ক্রমবিবর্তনে সঙ্কুচিত হয়ে নিউট্রন স্টারে রূপান্তরিত হতে পারে। আগেই বলেছি, বিস্ফোরনের ফলে নক্ষত্রের বাইরের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে এদের ভর মোটামুটি দাঁড়াবে সূর্যের ভরের এক থেকে আড়াই গুণ। এদের ব্যাসার্ধ ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার। এর থেকে সহজেই বোঝা যায়, এদের বস্তু বা মাটি প্রচন্ড ভারি। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- ছোট চা চামচের এক চামচ মাটির ওজন হবে পৃথিবীর সব মানুষের মোট ওজনের সমান। নিউট্রন নক্ষত্রে অভিকর্ষীয় ত্বরণ বা ‘G’ এর মান অত্যাধিক বেশি। তাই যদি এক ইঞ্চি উপর থেকে একটি মার্বেলগুলি নক্ষত্রের মাটিতে ফেলা হয়, তবে যে শক্তি নির্গত হবে তা নাগাসাকি-হিরোসিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণের চেয়েও বেশি। মাধ্যাকর্ষণ বেশি বলে এদের উপরের তল খুব মসৃণ। যদি নিউট্রন নক্ষত্রে কোনও পাহাড় থেকেও থাকে, তার উচ্চতা খুব বেশি হলে এক সেন্টিমিটার হবে। আর ঐ এক সেন্টিমিটার উঁচু পাহাড়ে চড়তে যে শক্তি ক্ষয় হবে; তাতে ১০ লক্ষ বার এভারেস্টে ওঠা যাবে। নিউট্রন নক্ষত্রের পৃষ্ঠদেশে চুম্বকক্ষেত্রের পরিমাণ ১০ লক্ষ কোটি গাউস, ব্রহ্মান্ডের অন্য কোথাও এত অত্যাধিক পরিমাণ চুম্বক ক্ষেত্র আছে বলে জানা যায় নি।
বিগত বিশ বছর ধরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল স্যাটেলাইট, কমপিউটার, রেডিও টেলিস্কোপ প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্যে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা নিউট্রন নক্ষত্রের গঠন রহস্য নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এ সম্বন্ধে আরও বহু তথ্য আমরা জানতে পারবো।

Join our mailing list Never miss an update